Thank you for trying Sticky AMP!!

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

আমাদের মেধাবী ছাত্রদের সুবাদে কত দেশই না ভ্রমণ করেছি। এবার একজন নিবেদিতপ্রাণ গবেষক ও সহকর্মী অধ্যাপক সাইদুর রহমানের সুবাদে নেপাল ভ্রমণের সুযোগ হলো। অ্যালগরিদম ও কম্পিউটেশন বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মশালা ‘ওয়ালকম ২০১৬’-এ অংশগ্রহণের জন্য এবার নেপালে যাত্রা। এটা ওয়ালকমের দশম আন্তর্জাতিক কর্মশালা। আর এর আয়োজক হলেন অধ্যাপক সাইদুর রহমান।
পৃথিবীর নানা মহাদেশের পাঁচ-ছয় ডজন দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ হলেও পর্যটকদের আকর্ষণস্থল নেপালে কখনো আসা হয়নি। অধ্যাপক সাইদুর রহমানের আয়োজিত কর্মশালায় ঘড়ির কাঁটা অনুসারে সময় মেনে চলতে হয়।
সুতরাং বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমাকে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হলো। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে ফ্লাইট হলেও সকাল আটটায় বের হয়ে পড়লাম। নয়টায় পৌঁছে তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পালা। বিমানবন্দরে ঢুকেই দেখি আমাদের ফ্লাইটের চেক-ইন করার ঘোষণা। শুনে বেশ খুশি। ইমিগ্রেশন পার হয়ে ট্যাবে রাখা কিছু পেপার পড়ব। কাউন্টারে গিয়ে দেখি, কাউন্টার ফাঁকা। মিনিট চল্লিশেক পরে চেক-ইন শুরু হলো এবং প্রথম যাত্রীর চেক-ইন যখন মাত্র ২০ মিনিটেই শেষ হলো, তখন বুঝতে পারলাম একটু আগে আসা কত বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে।
ফাঁকা ফ্লাইট দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। যাত্রী বেশি হলে কত টাকাই না এই ফ্লাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান তথা বাংলাদেশ উপার্জন করতে পারত। কোনো একটি জাতীয় দৈনিকে একবার পড়েছিলাম, আমাদের বিমান হতে পারত সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়ের সংস্থা।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব দেশ সারা পৃথিবীর যাত্রী বহন করে কত পয়সা উপার্জন করছে আর এত বড় জনসংখ্যার দেশ হয়েও, যার কোটি মানুষ বিদেশে চাকরি করে রেমিট্যান্স পাঠায় এবং নিয়মিত দেশে যাতায়াত করে, সেই দেশের জাতীয় বিমান সংস্থার এ বেহাল অবস্থা!
যা-ই হোক, একসময় বিমান উড়ল। এর মধ্যে আবার ত্রিভুবন বিমানবন্দরের দৃশ্যমান দূরত্ব মাত্র ২ হাজার মিটার হওয়ায় আমাদের ক্যাপ্টেন জানিয়ে দিলেন, ৩ হাজার মিটার না হলে অবতরণ করা যাবে না এবং সেই সুবাদে ৭০০ কিলোমিটারের পরিবর্তে বিমানবন্দর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ঘুরপাক খেয়ে দিব্যি ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পরিশেষে অবতরণ।
২০০৭ সাল থেকে আমরা ওয়ালকম কর্মশালাটি বাংলাদেশ-ভারতে পালাক্রমে আয়োজন করে যাচ্ছিলাম। অধ্যাপক সাইদুর রহমান স্বল্প ব্যয়ে বিশ্বমানের একটি কর্মশালা করতে বদ্ধপরিকর। তাই মূলত আমাদের এই এলাকায় এ কর্মশালা বেশির ভাগ সময় আয়োজিত হবে—এটাই প্রত্যাশিত।
উন্নত দেশের অনেকেরই লোভনীয় গন্তব্য যেখানে নেপাল, সেখানে আয়োজন করা যায় কি না, এ জন্য আমি আমার এআইটির সহপাঠী প্রমোদ প্রধানকে জিজ্ঞাসা করাতে সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। সমস্যা বাধল এপ্রিলের ভয়াবহ ভূমিকম্প, যাতে এই ছোট দেশটি লন্ডভন্ড। শুধু তা-ই নয়, এরপরই এ দেশে চলল নানা ধরনের অবরোধ, বিদ্যুতের অভাব, পেট্রলের অভাব; যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
শান্তিপ্রিয় নেপালিরা সবই মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। খোদ রাজধানীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিয়মিত লোডশেডিং, পেট্রল স্টেশনে শ দুয়েক মোটরবাইকের লাইন পেট্রলের জন্য। চারদিকে ভূমি ও পর্বত দিয়ে বদ্ধ দুর্বিষহ এক জীবন। ভাগ্যিস আমাদের বঙ্গোপসাগর রয়েছে।
নেপালে পণ্য আমদানিতেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। যেকোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা যায় না। দুর্বল মানুষ শুধু চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। দুর্বল হলেও মানবতার দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষোভ উপেক্ষা করার মতো নয়। পাহাড় কেটে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারিত হলে তখন মূল্যটি বোঝা যাবে।
যা হোক, আমরা কর্মশালার ভেন্যুতে এসেও অভিভূত হলাম। যে রকম পরামর্শ, ঠিক সে রকম কাজ। এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের ক্যাম্পাস দেখেই মনে হয় পড়ালেখার পরিবেশ রয়েছে। মূল ভবনের মাঝখানে জায়গা রেখে ভবন তৈরি করা হয়েছে। উঁচুতে অবস্থিত ক্যাম্পাস থেকে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
কর্মশালার জন্য নির্দিষ্ট অডিটোরিয়ামটি মানানসই, সব ভোজের জন্য এদের হোটেল ম্যানেজমেন্টের কোর্সের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে চমৎকার ব্যবস্থা; যা দেখে উন্নত দেশের অধ্যাপকেরাও উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করলেন। পরিবেশন, আপ্যায়ন, স্বাগত জানাতে বিনয়, আন্তরিকতা ও কর্মনিষ্ঠার কোনো অভাব নেই। সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাথে। যত মানুষের সঙ্গে দেখা হলো, বিনয়ের কমতি নেই।
রাজধানীর ৩০ কিলোমিটার দূরে প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত, অলাভজনক বেসরকারি হলেও বিরাট জায়গা নিয়ে তার ক্যাম্পাস। আমাদের মতো সব বিশ্ববিদ্যালয়ই রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত নয়।
১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিদেশি অধ্যাপকদের জন্য থাকার জায়গা রয়েছে, রয়েছে বিদেশি ছাত্রদের জন্য হল, উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে রয়েছে সমঝোতা স্মারক। এর অদূরেই ধূলিখেল। পর্বতে খাঁজ কেটে গড়ে উঠেছে দরিদ্র মানুষের জনপদ, যা ভূমিকম্পে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে ধূলিখেল থেকে পর্বতের দৃশ্য বড়ই মনোরম। যত জায়গায় গেলাম, ভূমিকম্পের চিহ্ন সব জায়গায়ই ছড়িয়ে রয়েছে।
কর্মশালার প্রোগ্রাম কমিটিতে ছিলেন ১৬টি দেশের অধ্যাপক, স্টিয়ারিং কমিটিতে ছিলেন ছয় দেশের নয়জন অধ্যাপক। এখানে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ৪০ জন গবেষক। বাংলাদেশ থেকে অধ্যাপক সাইদুর রহমান, সোহেল রহমান ও ড. ইকবাল হোসেন।
এর পরের আসর বসবে তাইওয়ানের সিনচুতে অবস্থিত ন্যাশনাল চিয়াও টুন ইউনিভার্সিটিতে। সুতরাং ওয়ালকম কর্মশালা আমাদের উপমহাদেশের বাইরে গিয়েও জায়গা করে নিচ্ছে। এআইটি এমের চেয়ারম্যান আমাদের অধ্যাপক সাইদুর রহমানকে ওয়ালকমের পিতা বলে সম্বোধন করেছেন। এটা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অত্যন্ত বড় মাপের সফলতা। ওয়ালকম কর্মশালার এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক, এর সঙ্গে বাংলাদেশের নাম বারবার উচ্চারিত হোক। এ রকম মাপের বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের দেশের শিক্ষক-অধ্যাপকেরা আরও আগ্রহী হয়ে উঠুন—এই কামনা করছি।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।