Thank you for trying Sticky AMP!!

‘দ্বিতীয় মেগা প্রকল্পের’ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি

‘আর্থিক বিবৃতি প্রদান একপ্রকার ধর্মীয় আচার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পালন করতে হয় রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা ও সৌজন্য প্রকাশের মাধ্যমে এবং তার সম্ভাব্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে ব্যবহৃত প্রভূত বাক্চাতুরীর দ্বারা উচ্চকিত রূপে, আর যা কখনোই পাঁচ ঘণ্টার নিচে সম্পন্ন হওয়ার নয়.... অতএব তিনি নানাবিধ নর্তন, কুর্দন, ভাব ও ভঙ্গিমার সঙ্গে চার ঘণ্টার একটি বক্তৃতা প্রদান করলেন।’ সাংবাদিক হিসেবে কার্ল মার্ক্স নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রথম স্তবকের এক অংশে ১৮৫৭ সালের ইংল্যান্ডের নতুন বাজেট সম্পর্কে এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন।

সারা বিশ্ব এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো দেশে অভিঘাতের মাত্রা বেশি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসম্পন্ন দেশের সহ্য করার ক্ষমতা বেশি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। জনদুর্ভোগও বেশি। সামাজিক নিরাপত্তা জাল অন্তত তিনটি বড় ধরনের সমস্যাক্রান্ত হওয়ায় বাইরের ধাক্কা মোকাবিলার সক্ষমতাও কম। প্রথমত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো ছড়ানো-ছিটানো। ২২ থেকে ২৩টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এগুলো পরিচালনা করছে। সংখ্যা হিসাবে কেউ বলছেন ৯৯টি; আবার কারও হিসাবে ১২২। এ ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও প্রকট। দ্বিতীয়ত, যাঁদের এ তালিকায় থাকার কথা, তাঁরা অনেকেই তালিকাভুক্ত হননি। তৃতীয়ত, শর্ত পূরণ না করেও অনেকে রাজনৈতিক আনুকূল্যে বা অন্যান্যভাবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।

গত ৩০ বছরে যে অগ্রযাত্রা হয়েছিল, কোভিডকালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা দারিদ্র্য বিমোচনে বিপরীতমুখী পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের আগে থেকেই খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। জ্বালানির দামও বেড়েছে। অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়নির্বাহে সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যভাবে বললে, সমাজে ভাঙন চলছে।

আর্থিক বিবৃতি জানাচ্ছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের ৩ শতাংশের কাছাকাছি। হিসাবটা ঠিকঠাক করলে তা দেড় শতাংশের বেশি নয়। বরাদ্দ কম কেন? মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় কর আদায় অন্যান্য দেশের তুলনায় একেবারে তলানির দিকে। অন্যদিকে কতগুলো খাতে (ঋণ পরিশোধ, বেতনভাতাদি) দিন দিন বরাদ্দ বাড়ছেই। এ ক্ষেত্রে শুভংকরের ফাঁকিও সবার জানা। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পেনশন, বেতন-ভাতাদিরই একটা অংশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতের হিসাবে দেখানো হয়। এর পরিমাণ অনেক বেশি। আবার বিভিন্ন খাতের ভর্তুকিও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ হিসেবে দেখানো হয়। ভর্তুকি কৃষকের দরকার; রপ্তানি বা উৎপাদনক্ষমতা বজায় রাখার জন্য পানি, গ্যাস, বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়াই যেতে পারে। তবে সব ভর্তুকি কি খানায় বা কারখানায় যাচ্ছে? যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদিত না হলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর ব্যয় বেড়েই চলছে। ফলে রাজস্ব ব্যয়ে শৃঙ্খলা আনা বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজস্ব খাত থেকে অধিক বরাদ্দের মাধ্যমে নিষ্কৃতির আকাঙ্ক্ষা-আশা হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।

বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে কি জনগণের কোনো ভূমিকা আছে? দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, নেই। বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বা বাজেট অর্থবিল হওয়ায় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয় না। সংসদে পেশ করা হয়। অর্থমন্ত্রী উত্থাপিত বিল সংসদ পাস করে। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ সদস্যরা নতুন প্রস্তাব যুক্ত করতে পারেন না। সংবিধানে দলের বাইরে গিয়ে কারও ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়—জাতীয় বাজেট: কার জন্য, কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হয়?

মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম সহজে কমবে—এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা নেই। মূল্যস্ফীতি মুদ্রা সরবরাহের কারণে ঘটলে সুদের হার বাড়িয়ে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করছে। সরকারি হিসাবে নেই; কিন্তু বেসরকারি বিভিন্ন হিসাবে নতুন দরিদ্র যোগ হয়েছে। কোভিড প্রাক্কালেই মোট দেশজ উৎপাদনে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির ছিল এবং অতিমারিকালে তা সংকুচিত হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হয়নি। হার হিসাবে কর থেকে আয় বাড়েনি। ফলে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে জীবনযাত্রার ব্যয়নির্বাহের সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানোও এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

ইতিহাসের দিক থেকে চিন্তা করলে উত্তরণের অন্তত তিনটি মাইলফলক পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে পুনর্গঠন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পুনরুদ্ধার এবং ১৯৩০ সালের মহামন্দা থেকে উত্তরণ। ১৯৪৩ সালের জুন মাসে তাঁর দেশের অর্থমন্ত্রীর জন্য ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ লর্ড জন মেইনারড কেইন্স ‘মেইনটেন্স অব এমপ্লয়মেন্ট’ নামক নোটে কর্মসংস্থানকে সংকট থেকে উত্তরণের মূল পন্থা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। প্রাক্‌-কোভিডকালেই বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছিল। যুব বেকারত্ব বেশি বাড়ছিল এবং শিক্ষিত যুব বেকারত্ব আরও বেশি হারে বাড়ছিল। কোভিডকালে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের দুই বছরের বেশি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। শিক্ষাজীবন শেষ করে তাঁরা শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করতে পারতেন, আয় করতে পারতেন এবং তাঁরা যঁাদের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের একধরনের দায়মুক্ত করতে পারতেন। এর কোনোটাই পারেননি। ফলে জনমিতির লভ্যাংশ থেকেও দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক খাতে ঋণাত্মক কর্মসংস্থান হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ার বিপরীতে অর্থনীতির পরিভাষা অনুযায়ী বিশিল্পায়ন ঘটছে। এটা মোটেই শুভকর লক্ষণ নয়। এবারের বাজেটে সবাই অধিকারভিত্তিক এবং আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান তৈরিকারী একটি মেগা প্রকল্প চেয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছিল। লর্ড বেভারেজ যুক্তরাজ্যে সামাজিক নিরাপত্তার কাঠামো বানিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রংপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাসের পরিহাস, রংপুর বিভাগ আজও বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের ঠিকানা! ত্রিশের মহামন্দা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট বিভিন্ন খাতে কর বাড়ান এবং সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেন। তিনি চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ মানুষকে নগদ সহায়তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ৩৫ লাখের বেশি মানুষের কাছে তা পৌঁছায়নি। সংকট উত্তরণে ‘সর্বজনীন জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা’ দ্বিতীয় মেগা প্রকল্প হিসেবে যাতে গ্রহণ করা হয়, সেই আকাঙ্ক্ষা অনেকের ছিল।

Also Read: বাজেটে সরকার নিজেই নিজের কথা রাখেনি

এ প্রকল্প জীবনযাত্রার সংকট থেকে উদ্ভূত ‘নিম্ন সামাজিক ফাঁদ’ থেকে উত্তরণ ঘটাতে বড় রকমের ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের মানুষকে যেন আর পিছিয়ে না পড়তে হয়। যেকোনো অভিঘাত সহ্য করার ক্ষমতা যেন তাদের থাকে। সে জন্য শিশুকে প্রতিপালনকালে মাতৃত্ব ভাতা দরকার। অধিকারভিত্তিক বেকারত্ব ভাতা আবশ্যিক। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখন বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর বড় কারণ বেকারত্ব।

কর বাড়লে রাষ্ট্রের রাজস্ব সক্ষমতা বাড়বে। রাষ্ট্র তখন সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দিকে মনোযোগী হবে। তাই তৃতীয় মেগা প্রকল্পে—আয়কর রাজস্ব আয়ের এক নম্বর খাত হোক। তাহলে প্রগতিশীল করব্যবস্থা চালু হবে। যার আয় বেশি, তিনি কর বেশি দেবেন। মূল্য সংযোজন করের মতো সবার জন্য সমান কর নয়। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। করব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন।

Also Read: ফি বছর রাজস্ব কেন কমে?

কেইন্স তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, উন্নয়ন বাজেট হবে একটি ‘মৌলিক ধারণা’ আর ঘাটতি অর্থায়ন হলো ‘মরিয়া অনৈতিক সুবিধামাত্র’। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে সেই ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছিল। উন্নয়ন ব্যয় ৬০০ কোটি আর অনুন্নয়ন ব্যয় ১৮৬ কোটি ছিল। এ অনুপাত এখন উল্টো হয়ে গেছে।

জনগণের অর্থের নজরদারি ও জবাবদিহি দরকার। উদাহরণস্বরূপ, এনবিআর আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে এক তথ্য আর বাংলাদেশ ব্যাংক আরেক তথ্য দিচ্ছে। একটু খতিয়ে দেখে ফারাক বের করা দরকার। টাকা পাচার হচ্ছে। আবার বাজেটে দেখা যাচ্ছে অপরাধকে একধরনের জায়েজ করার চেষ্টা।

বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে কি জনগণের কোনো ভূমিকা আছে? দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, নেই। বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বা বাজেট অর্থবিল হওয়ায় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয় না। সংসদে পেশ করা হয়। অর্থমন্ত্রী উত্থাপিত বিল সংসদ পাস করে। জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ সদস্যরা নতুন প্রস্তাব যুক্ত করতে পারেন না। সংবিধানে দলের বাইরে গিয়ে কারও ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়—জাতীয় বাজেট: কার জন্য, কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হয়?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন