Thank you for trying Sticky AMP!!

ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পরিণতি

আসিয়া বিবি

আসিয়া বিবি জানে আপাতত বেঁচে গেছেন, কিন্তু তাঁর শেষরক্ষা হবে, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

দীর্ঘ ৯ বছর মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘাড়ে নিয়ে তিনি দিন কাটিয়েছেন। সম্ভবত জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ব্লাসফেমি বা ধর্মীয় অবমাননাকর মন্তব্য করার অপরাধ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু মুক্তি পেয়েও মৃত্যুর কালো ছায়া এখনো তাঁর পিছু ছাড়েনি। পাকিস্তানে দাবি উঠেছে, তাঁকে ফাঁসি দিতে হবে। শুধু তাঁকে নয়, যে বিচারকেরা তাঁর মুক্তি দিয়েছেন, তাঁদেরও ফাঁসি চাই। দেশের সেনাবাহিনীর প্রধানেরও ফাঁসি চাই, কারণ তিনি আহমদিয়া। এসব নিয়ে এখন সারা পাকিস্তানে তুলকালাম কাণ্ড চলছে।

৪৭ বছর বয়সী আসিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, গ্রামের কুয়া থেকে পানি খেতে গিয়ে স্থানীয় নারীদের সঙ্গে বচসার সময় তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নামে কুৎসা রটনা করেছেন। আসিয়া একজন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, নিরক্ষর, দরিদ্র গ্রাম্য নারী। কোনো প্রমাণ ছাড়া, এক স্থানীয় মৌলভির অভিযোগের ভিত্তিতে ২০০৯ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১০ সালে পাঞ্জাবের একটি স্থানীয় আদালত তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেন। সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে লাহোর হাইকোর্টের বিচারকেরা সে রায় সমর্থন করে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। প্রায় এক দশক পর গত মাসে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সে আদেশ বাতিল করে আসিয়াকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেন। তারপর থেকেই দেশটিতে এক মহা দক্ষযজ্ঞ কাণ্ডের শুরু।

অবশ্য দক্ষযজ্ঞ শুরু আসিয়া বিবির নামে অভিযোগ ওঠার পর থেকেই। তাঁর পক্ষে দুকথা বলেছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির। ২০১১ সালে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর সেই দেহরক্ষী মুমতাজ কাদরীকে ফাঁসি দেওয়া হয়, তবে মানুষ খুন করে তিনি রাতারাতি পাকিস্তানিদের চোখে অতি সম্মানিত ধার্মিক পীর বনে যান। মুমতাজ কাদরী খুন করে এতটা পূজনীয় হয়ে ওঠেন যে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা উঠলে সে মামলায় লড়তে সম্মত হন, এমন কোনো আইনজীবী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

শুধু সালমান তাসির নন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও একই কারণে নিহত হন। তিনিও সালমান তাসিরের মতো আসিয়া বিবির পক্ষ নিয়েছিলেন, ব্লাসফেমি আইনের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। আইনটা এমনভাবে লেখা যে শত্রুতাবশত ধর্মের বিরুদ্ধে কুৎসার অভিযোগ এনে যে কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে পারে। এই আইনের ফলে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা। তাদের নামে অভিযোগ করা সহজ, আর অভিযোগ করলেই সবাই তা সত্য বলে বিশ্বাস করে। শাহবাজ জানতেন, এ কথা বলার জন্য তাঁর মৃত্যু হতে পারে। মৃত্যুর চার মাস আগে রেকর্ডকৃত এক অন্তিম বক্তব্যে তিনি বলেন, মৃত্যু হলেও তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকার সমর্থন করে যাবেন। তিনি ও সালমান তাসির যে পিপলস পার্টির সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, সেই সরকারের কেউ মুখ ফুটে এ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। উল্টো ব্লাসফেমি আইনের সাফাই গেয়ে বলেছিলেন, এই আইন বদলের কোনো প্রশ্ন ওঠে না। যেমন আইন, তেমনি থাকবে।

৯ বছর জেলে থাকার পর আসিয়া মুক্তি পাওয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে শুধু বিচারকদের নয়, যে উকিল তাঁর পক্ষে ওকালতি করেছেন, তাঁকেও দেখে নেওয়া হবে—এমন হুমকি দিয়েছিলেন তেহরিক-ই-লাব্বায়েক দলের প্রধান আফজাল কাদরী। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এই হুমকির প্রতিবাদ করেছিলেন, তাতে কাদরী সাহেবরা তাঁকেও দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সম্ভবত ইমরানের সমালোচনা শুনেই বুকে বল পেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা। তিন সদস্যের এক বিচারকমণ্ডলী প্রমাণের অভাবে আসিয়া বিবিকে মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু তারপর তাঁরা যে যাঁর মতো লুকিয়ে পড়েন। যে উকিল আসিয়ার পক্ষ নিয়ে আদালতে লড়াই করেছিলেন, তিনিও কোনো কথা না বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন নেদারল্যান্ডসে।

ততক্ষণে অবশ্য পাকিস্তানে ছোট-বড় নানা শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে হাজার হাজার মানুষ, অচল হয়ে পড়ে লাহোর, করাচি ও ইসলামাবাদের মতো প্রধান শহরগুলো। বিপদ সামলাতে সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়, কিন্তু সেখানেও ভয়, সেনাবাহিনীর অনেকেই কাদরী সাহেবের মুরিদ।

বিক্ষোভকারীদের দাবি, আসিয়াকে কিছুতেই দেশ ছেড়ে যেতে দেওয়া যাবে না, তাঁকে ফের আটক করতে হবে। বিপদ টের পেয়ে সেনাবাহিনী অবশ্য মুক্তির পরপরই গোপনে তাঁকে সেনাসদরে নিয়ে যায়। অনেকের ধারণা, তাঁকে সম্ভবত সেনা প্রহরায় ইতিমধ্যে অতি সতর্কতায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, যদিও মুখে বলা হচ্ছে আসিয়া দেশের ভেতরেই আছেন। এমন একটা কিছু হয়ে থাকতে পারে, এই সন্দেহে কাদরীর সমর্থকেরা সেনাবাহিনীর প্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার ফাঁসি দাবি করে বসেছেন। তাঁদের যুক্তি, কামার নিজেই বিধর্মী,
তিনি আহমদিয়া সম্প্রদায়ের। তিনি তো আসিয়ার পক্ষে থাকবেনই।

পাকিস্তানে সাধারণত যেমন হয়, এবারও ঘটনা সে দিকেই যাচ্ছে। মৌলবাদীরা যখন ফুঁসে ওঠে, তখন সে দেশের রাজনীতিকেরা নিজেদের সামলাতে বরাবরই আপসের পথ বেছে নেন। কেউ কেউ ভেবেছিলেন বিক্ষোভকারীদের প্রতি নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে রকম কঠোর সমালোচনা করেন, তাতে নিশ্চয় তিনি ধর্মীয় রাজনীতিকদের চাপের মুখে স্থির থাকবেন। তিনি নিজেও ধর্মকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে ক্ষমতায় এসেছেন, সামরিক বাহিনীও তাঁর পক্ষে রয়েছে। কী বলব, তিন দিনের হরতালেই তাঁর সরকারের সেই কল্পিত দৃঢ়তা ভেঙে পড়ে। রীতিমতো হাতেপায়ে ধরে ইমরানের সরকার আফজাল কাদরীর দলের সঙ্গে এক আপস চুক্তি করেছে। এতে বলা হয়েছে, আসিয়ার ব্লাসফেমি মামলা পুনরায় বিবেচনার জন্য আদালতে ফেরত পাঠানো হবে। আসিয়াকে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হবে না—এমন প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানে এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। ১৯৪৯ সালে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে সেখানে যে সহিংসতার সৃষ্টি হয়, তা সামলাতে লাহোরে সামরিক আইন জারি করতে হয়েছিল। সেই ধাক্কায় মৌলবাদীদের হাতে রাখতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে তথাকথিত ‘অবজেকটিভ রেজল্যুশন’ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যেখানে অন্য যেকোনো নীতির ঊর্ধ্বে ধর্মকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। শাসনতন্ত্রের ধর্মীয়করণ দিয়ে শুরু, ৪৫ বছর পর সেই পাকিস্তান এখন আরও বেশি মাত্রায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দেশ, যেখানে সামান্য এক নিরক্ষর ও নিঃস্ব খ্রিষ্টান নারীকে ফাঁসি থেকে বাঁচাতে সরকারকে আপস চুক্তি করতে হয় এক মৌলবাদী দলের সঙ্গে। এটা যে রাজনীতি, এর সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে ধর্মের সম্পর্ক নেই, এ কথা বুঝতে কাউকে রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না।

ঘটনা পাকিস্তানের, কিন্তু এর ঢেউ তার সীমান্তের বাইরে গিয়েও লাগবে, তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের নিজের দেশের রাজনীতিতেও দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে ধর্মের প্রবেশ ঘটছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের দেউলিয়াপনা থেকে আমরা যদি এখনো কিছু না শিখি, তাহলে আমাদের পরিণতি কী হতে পারে, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি