Thank you for trying Sticky AMP!!

ধর্ষণের দমবন্ধ করা সংস্কৃতি

ধর্ষণের সংবাদহীন কোনো দিন আর নেই। ধর্ষণের শিকার যাঁরা হচ্ছেন, তাঁদের বিশেষ কোনো জনমিতিক চরিত্র আর নির্দিষ্ট করা যায় না। শিশু থেকে প্রৌঢ়, ধনী থেকে দরিদ্র, গ্রাম কিংবা শহরবাসী, বিবাহিত বা অবিবাহিত, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, কামিজ-হিজাব-শাড়ি-টপস পরিহিত, যে-কেউ এর শিকার হতে পারেন। ধর্ষণের কোনো নির্দিষ্ট পরিসর কিংবা সময় নেই, যেখান থেকে গা বাঁচিয়ে চলা যায়। ঘরের ভেতর, উৎসবের ময়দান, মিলনায়তন, কর্মক্ষেত্র কিংবা আসা-যাওয়ার পথ, সর্বত্র লোলুপ থাবা। ধর্ষকের আগ্রাসনে আক্রান্ত হন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশ নারী, কিয়দংশ পুরুষ বা বালক। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পুরুষ বা বালক ধর্ষিত হলে তা প্রকাশ করা আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

গণমাধ্যমে যতটুকু জানি, তাও শুধু ডুবোপাহাড়ের ভাসমান চূড়াটুকু। তারপরও ধর্ষণের যতগুলো ঘটনা প্রতিদিন নজরে আসে, তার পৌনঃপুনিকতা প্রমাণ করে, ধর্ষণ অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ বলে গণ্য হয়ে উঠেছে। যতই খারাপ লাগুক শুনতে, আমাদের মেনে নিতে হবে, ধর্ষণকে আমরা যাপিত সংস্কৃতির অংশ করে তুলেছি। ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে না দেখা, ধর্ষণের দায় ভিকটিমের ওপরেই বর্তানো এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের বিচার ও অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি না হওয়া এ ধরনের একটি সহিংস পরিবেশ তৈরি করেছে। এর এই পরিবেশেই একজন অভিযুক্ত ধর্ষকের পিতা নির্দ্বিধায় পুত্রের ভয়ংকর অপরাধকে ‘জোয়ান বয়সে একটু-আধটু করা’ বলে বৈধতা দেন।

সুতরাং এ ধর্ষণ সংস্কৃতির অবসান চাইলে সমাজে যেসব ব্যবস্থা, বিশ্বাস বা আচরণ ধর্ষণকে বৈধ করে এবং ধর্ষক তৈরি করে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সমাজের শুধু বিশেষ ধরনের কিছু লোক—‘অসুস্থ-পশু-বিকৃতমনা-বখাটে’—ধর্ষণ করে, এভাবে বলে আমরা যত দিন ধর্ষকদের আলাদা কোনো প্রজাতি বলে চিহ্নিত করব, তত দিনই অস্বীকার করা হবে যে ধর্ষক আমাদের মধ্যেই তৈরি হয় ও স্বচ্ছন্দে থাকে।

ধর্ষণের নখরে ছিন্নভিন্ন নারীদের রক্তরেখায় বাংলাদেশের জন্ম। ধর্ষণ যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধ, সেটি এই দেশের মর্মমূলে প্রোথিত থাকা উচিত। অথচ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরেও ধর্ষণের শিকার যে নারীরা বেঁচে গেছেন, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই সমাজ তাঁদের গ্রহণ করেনি। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতি দিতেও চার দশকের অধিক কাল লেগে গেছে।

অথচ একাত্তরের ধর্ষণ থেকেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠার কথা যে ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক অস্ত্র। একটি দেশ আর একটি দেশকে দখল, বিনষ্ট, ধ্বংস করার উপায় হিসেবে ধর্ষণকে ব্যবহার করে, তেমনি জাতিগত ঘৃণা প্রদর্শনের জন্য, শক্তি প্রদর্শনের জন্য, কাউকে দখলে রাখার জন্য ধর্ষণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমরা জানতে পেরেছি, বনানী ধর্ষণকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত সাফাত আহমেদ ধর্ষণের সময় চিৎকার করে বলেছে, ‘এই দেশের এয়ারপোর্টের সব সোনা কই যায়? কই থেইকা আসে? সব আমার বাপের আন্ডারে।’ সুতরাং এখানে ক্ষমতার প্রদর্শন করা, শক্তি প্রয়োগ করা, ভীতসন্ত্রস্ত করাই পৈশাচিক উল্লাসের অংশ।

পুং-আধিপত্যমূলক সমাজে ধর্ষকের অন্যায়ের দায়ভাগ ভিকটিমের ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। আর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই এভাবে অপরাধীকে ছাড় দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকানো হয় না। ধর্ষণের শিকারকেই অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে যে সমাজ, সেই সমাজে ধর্ষকমানস সবল অবস্থানেই রয়েছে বলা যায়। এই ধর্ষকমানসই ধর্ষকদের ছাড়পত্র দেয়।

এই ছাড়পত্র আছে বলেই আমরা দেখছি, ধর্ষক শুধু ধর্ষণই করছে না, তার কর্মকাণ্ডের ভিডিও তুলে রাখছে এবং এই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েই ধর্ষণ করছে। সম্প্রতি মা ও মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে হাজতবাসী সিলেটের নিমার আহমদ এভাবেই ধর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল। আজকের খবরেই জানতে পারছি, সেই মাকে তালাক দিয়ে মেয়েকে পরিত্যাগ করেছে তার বাবা। অর্থাৎ ধর্ষণের যাঁরা শিকার, তাঁদের সামাজিক সহায়তাও কেড়ে নেওয়া হয় সমাজ থেকে। কিংবা ধর্ষণের ভিডিও দেখার জন্য লোলুপ হয়ে থাকে অনেকের চোখ। এমনকি আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন বিবাহিত নারীর কথা জানি, যার স্বামী ভয় দেখিয়েছে এই বলে যে তার নগ্ন ভিডিও ছড়িয়ে দেবে। ভেবে দেখুন, যে ভিডিও ছড়াবে বলছে, এর মানে সে জানে, ভিডিওতে তার চেহারা দেখা গেলেও ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই, বরং যাকে নির্যাতন করা হচ্ছে, তার চেহারা দেখা যাওয়াই খারাপ।

সুতরাং শুধু ধর্ষণের যথাযথ বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের মধ্যেকার ধর্ষকমানসটিকে চিহ্নিত করে, তার অবসান ঘটানো জরুরি। দৈনন্দিন কথাবার্তায়, উপমায়, অনুষঙ্গে ধর্ষণের যেসব সমার্থক শব্দ আছে, সেগুলো পরিহার করতে হবে। যেমন কাউকে গালি দেওয়ার জন্য অনেক সময়ই ধর্ষণেচ্ছা প্রকাশ করা হয়। কথায় কথায় আপনি কি কিছু ধর্ষণ করতে চাইছেন? ধর্ষণকে কি পুরুষালি আচরণ মনে করছেন? ধর্ষণের শিকারকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করছেন? নিজেকেই প্রশ্ন করুন। আপনার পরিবারের পুরুষ সদস্যকে শেখান ধর্ষণ একটি অপরাধ। এর কোনো সাফাই হয় না।

ধর্ষকমানস এবং ধর্ষণের সংস্কৃতি শুধু নারী নয়, আমাদের সবাইকে বিপন্ন করে রাখে। গাজীপুরে হযরত আলীর আত্মহত্যা বুঝিয়ে দেয় যে, সম্ভাব্য ধর্ষকের বিষাক্ত নিশ্বাসের মধ্য থেকে জীবন যাপন করা নারী-পুরুষনির্বিশেষে কারও জন্যই মেনে নেওয়ার মতো জীবন নয়।

গীতি আরা নাসরীন। শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।