Thank you for trying Sticky AMP!!

ধর্ষণের পেছনে কী কাজ করে

আমি প্রায়ই বলে থাকি, ‌‘এই মানুষেরা দানব নয়।’ যারা ধর্ষণ করে, করে কারাগারে আছে, তাদের সম্পর্কে বলেছেন মধুমিতা পান্ডে। মধুমিতা যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড হালাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তাঁর বিষয় অপরাধবিজ্ঞান। তিনি ভারতের নয়াদিল্লির তিহার কারাগারে ধর্ষণের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ১০০ জন কয়েদির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সব ধরনের মান ও শর্ত মেনে নিয়ে তিনি জেলে বসে এই অপরাধীদের সাক্ষাৎকার নেন। তিনি বুঝতে চেয়েছেন ধর্ষণকারীদের মনস্তত্ত্ব। তাদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, সামাজিক পরিবেশ, মনমানসিকতা, অপরাধ সংঘটনের পর তারা কি অনুশোচনায় ভোগে?

২০১৮ সালের আগস্টে ফার্স্টপোস্ট অনলাইন ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে গবেষক মধুমিতা পান্ডে বলেছেন, ধর্ষণকারীদের পশু বলা, জানোয়ার বলা, দানব বলা সমস্যার সমাধান নয়। তাতে হয় কি, আমরা সমাজের ভালো মানুষ, আমরা রেপের জন্য দায়ী নই, আর ওরা হলো জন্তু-জানোয়ার, ওরা দায়ী—এই রকম একটা সহজ দায়মুক্তির ধারণা সমাজে চলে আসে। মধুমিতা বলেছেন, ধর্ষণ একটা লম্বা সুতা, যার এক প্রান্তে আছে ধর্ষণ নামের ক্রিয়াটি। কিন্তু এটা শুরু হয়েছে সমাজের আরও আরও অনুষঙ্গ থেকে—নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখা, ইভ টিজিং, নারীবিদ্বেষী কৌতুক, নারীকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, হয়রানি—এ ধরনের কম গুরুতর বলে বিবেচিত উপাদানগুলোই শেষতক ধর্ষণে গিয়ে পৌঁছায়।

মধুমিতার গবেষণা থেকে কোনো সাদা-কালো উপসংহার বেরিয়ে আসেনি। রেপিস্টরা সব অন্য ধাতুর তৈরি, এ রকম কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না মোটেও। কোনো কোনো অপরাধী তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, কেউবা অনুতপ্ত নয়। মধুমিতা একটা ঘটনাকে আলাদা করে দেখিয়েছেন। ৪৯ বছরের একজন মন্দির পরিচ্ছন্নতাকর্মী ধর্ষণ করেছিল ৫ বছরের এক বালিকাকে। মেয়েটির মা ভিখারিনি ছিলেন। অপরাধী বলেছে, বাচ্চাটা তাকে উসকানি দিত, তার শরীর স্পর্শ করত, তাই তাকে সে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। তার মতে, বাচ্চাটার মা-ও ভালো নয়। এখন সে অনুশোচনায় ভোগে। বাচ্চাটার কুমারীত্ব সে হরণ করেছে। মেয়েটার তো বিয়ে হবে না। পাঁচ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে এই লোক বাচ্চাটাকে বিয়ে করতে চায়। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মধুমিতা বলেছেন, ‘আফটার ইউ স্পিক টু [দ্য রেপিস্ট], ইট শকস ইউ—দিজ মেন হ্যাভ দ্য পাওয়ার টু মেইক ইউ ফিল সরি ফর দেম।’ (ধর্ষকদের সঙ্গে আলাপ করার পর আপনি ভীষণ নাড়া খাবেন—এসব লোকের এমন ক্ষমতা আছে যে তাদের কথা শোনার পর তাদের জন্য আপনার খারাপ লাগবে।)

সুতরাং আমরা যারা ভাবছি, যারা ধর্ষণ করে, তারা আলাদা, তারা মানুষ নয়। আমরা তারা নই, তাদের জন্য আরও বহু কিছু করণীয় আছে।

প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণের ৮ জুলাইয়ের খবর: (বাংলাদেশে) এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজারের বেশি নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পরে হত্যাসহ অন্যান্য নির্যাতনের হারও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। সোমবার সকালে ‘বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতি, অব্যাহত নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সামাজিক নিরাপত্তা’র দাবিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর সেগুনবাগিচার সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তনে এ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। আমরা জানি, সব ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয় না, মামলা হয় না, আমাদের গোচরে আসে না।

বিভিন্ন পত্রিকায় মধুমিতা পান্ডের সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে, তার ওপরে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এবং আমরা বারবার করে বলছি, পুরো সমাজে পুরুষাধিপত্য নারী নির্যাতনের, ধর্ষণের বড় কারণ। পিতৃতন্ত্র হাজার বছর ধরে জেঁকে বসে আছে, তার বিনাশ এক দিনে সম্ভব নয়, কিন্তু কাজ করতে হবে প্রতিনিয়ত, কাজ করতে হবে এখনই। ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ড হলো মাথার ওপরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা পিতৃতন্ত্রের একটা চরম দৃষ্টান্ত। প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, রাজনীতি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাবলয়—সবটা মিলিয়ে একজন তরুণীকে কীভাবে চেপে ধরল এবং অবশেষে আগুনে পুড়িয়ে মারল নৃশংসভাবে। আর নুসরাতের প্রতিবাদটা হওয়া উচিত আমাদের প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা আর প্রেরণার অনন্ত অনির্বাণ উৎস—‘আমি সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দেব, আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে যাব...’

মধুমিতা পান্ডে বলেছেন, এই ধর্ষকেরা সম্মতি (কনসেন্ট) কী, তা জানে না। অনেক সময় তারা কাম চরিতার্থ করার জন্যও ধর্ষণ করেনি। করেছে করা সম্ভব বলে। তারা যাকে ধর্ষণ করে, তাকেই আবার দোষারোপ করে: মেয়েটার পোশাক ভালো ছিল না, সে কেন রাতে চলবে ইত্যাদি। মধুমিতা বলেছেন, দিল্লির নির্ভয়ার বেলায় এই অজুহাত খাটে না, কারণ নির্ভয়া তথাকথিত শালীন পোশাক পরেছিলেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর বন্ধু ছিল। 

আমরা বলব, নুসরাতের বেলায় এই অছিলা খাটে না, তনুর বেলায় এই কুযুক্তি খাটে না, অসংখ্য শিশুর বেলায় এই কুযুক্তির অবতারণাই করা যায় না। 

মধুমিতা বলেছেন, সমাজকে প্রতিবাদী হতে হবে। মুখ খুলতে হবে। আইনের আশ্রয় নিতে সংকোচ-লজ্জা পেলে চলবে না। তিনি পারিবারিক শিক্ষার ওপরে জোর দিচ্ছেন, পরিবারের ভেতরে যৌনশিক্ষার কথা বলছেন। তিনি বারবার জোর দিয়েছেন তত গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন সব বিষয়ের ওপরে। যেমন নারীকে অবমাননা করা কৌতুক।

আজ আমরা দেখতে পাই, আমাদের সাহিত্য, সিনেমা, রূপকথা, কিংবদন্তি, কৌতুকে নারীকে হেয় করার উপাদান অনেক। আমি আমার ছোটবেলার কথা বলতে পারি। কোনো একটা ছেলে যদি কোনো সাহসের কাজ করতে ব্যর্থ হতো, আমরা তাকে নারী (কথাটা আরও নেতিবাচক) বলে হেয় করতাম। বৃষ্টির দিনে ফুটবল খেলা বন্ধ করে যখন স্কুলের বারান্দায় আড্ডা বসত, তখন কোনো একজন কত মেয়ের সঙ্গে কীভাবে মিলিত হয়েছে, তার রগড়পূর্ণ বর্ণনা দিত। আমরা ওই বয়সে তার গল্প কিংবা কর্মকে অপরাধ ভাবতে পারতাম না, হয়তো ‘খারাপ ছেলের খারাপ কাজ’ ভাবতাম। আমার প্রিয় একটা কবিতা আছে জয় গোস্বামীর—‘স্নান’। তাতে একটা লাইন আছে, ‌‘জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছ’। এই বাক্যটার মধ্যে আমাদের সমাজের পুরুষবাদী মনোভাবটা ধরা আছে। আমাদের নাটকে সিনেমায় তাই ‘চুমকি চলেছে একা পথে/ সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে/ রাগ কোরো না, সুন্দরী গো/ রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো’ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে পুরুষবাদী নিগৃহতন্ত্রের মনোভাবই কেবল ব্যক্ত হয়। 

মধুমিতা পান্ডের কথা প্রণিধানযোগ্য। ধর্ষণ হচ্ছে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষ ফল। প্রক্রিয়াটার মধ্যে আছে আমাদের দৈনন্দিন পুরুষবাদী মানসিকতা। বিচার চাই, শাস্তি চাই; কিন্তু পুরো পুরুষতন্ত্রকে কে ওলটাবে? শুরু করতে হবে পরিবার থেকে, স্কুল থেকে। আমার পরিবারে আমার নারীকে কি আমি সম্মান করি?

আমাদের গল্প, কবিতা, নাটক, সিনেমাগুলোয় আমাদের আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আমরা সিনেমায় দেখাই, একটা ছেলে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল, মেয়েটি রাজি নয়; তখন ছেলেটি নানাভাবে মেয়েটির পিছু নিল, কিছুতেই ওই মেয়েটির চিত্ত জয় না করে সে ছাড়বে না। আরে ভাই, পৃথিবীতে আরও অসংখ্য নারী আছে, অসংখ্য পুরুষ আছে, সবার তরে নহে সবাই...কিন্তু সিনেমায় দেখা যায়, নায়ক নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যায়, আর শেষতক নায়িকার সঙ্গে তার মধুর মিলন ঘটে। ওই চেষ্টার আরেক নাম ইভ টিজিং। ওই চেষ্টার আরেক নাম যৌন হয়রানি, যৌন অপরাধ। আমাদের কাহিনিগুলো নতুন করে লেখার সময় এসেছে।

তবে এটাও বলে রাখি, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়। আইনের শাসনই সমাধান। আইনকে গতিময় করুন, দ্রুততম সময়ে অপরাধীর আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিন। সুশাসনের পথে শর্টকাট বলতে কিছু নেই। 

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক