Thank you for trying Sticky AMP!!

ধর্ষণ এবং খুলনায় আরেক 'সীমা চৌধুরী'

প্রতীকী ছবি

ডেঙ্গুর আগে সব ধরনের মিডিয়ায় স্থান করে নিয়েছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংগঠিত হওয়া শিশু ধর্ষণের খবর, যা মানুষকে বিচলিত করেছিল। আর এখন ডেঙ্গুর মতো বিপর্যয়ের সময়ও খবর আসে যৌন নির্যাতনের এবং সেই ধর্ষণের অভিযোগ স্বয়ং রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেই। সাধারণ অর্থে পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব হলো কোনো বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা, ক্ষতিগ্রস্তের পক্ষে দাঁড়ানো, তাদের সেবা প্রদান, আসামিকে গ্রেপ্তার করা। কিন্তু এর বিপরীতে যখন তাদের বিরুদ্ধেই এই ধরনের অভিযোগ দাখিল হয়, তখন মানুষের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি, বিশেষ করে নারীর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি আরও জোরালোভাবেই অনুভূত হয়। সম্প্রতি খুলনা রেলওয়ে থানার (জিআরপি) ভেতর এক নারীকে আটকে রেখে রাতভর ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে। 

কিছুদিন আগেই ঢাকায় এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক পুলিশ কনস্টেবলসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নারী ধর্ষণ এই প্রথম নয়। ১৯৯৬ সালে সীমা চৌধুরী নামের এক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। তিনি তার বন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের রাউজানে সন্ধ্যায় পথ ধরে হাঁটছিল। রাউজান থানার পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়, তিনজন পুলিশ সদস্য তাঁকে ধর্ষণ করেন। যেহেতু সীমা চৌধুরী ওই সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক, রাষ্ট্র তাকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নিয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা কারাগারের ‘নিরাপদ হেফাজতে’ রহস্যজনকভাবে সীমার মৃত্যু হওয়ার পর অ্যাডভোকেট এলিনা খান তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়ী করে মামলা করেছিলেন। ২২ বছর পরেও কিন্তু সেই মামলার কোনো সুরাহা হয়নি আজ পর্যন্ত।

খুলনার এই ধর্ষণের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমিটিকে। এ ধরনের তদন্ত যে খুবই নিয়মমাফিক ও দায়সারা গোছের, তা সবাই অনুমান করতে পারেন। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে সেটি যখন পুলিশ বিভাগই তদন্ত করে, তখন সেটি কোনোভাবেই সঠিক তদন্ত হয় না। অন্তত আগের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেই খালি চোখেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। আর ফলাফল হলো ধর্ষণের ঘটনায় যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত না হয়, তাহলে পুলিশের কোনো কোনো সদস্যের মধ্যেই ধর্ষণমনস্কতার বেড়ে যায়। কারণ, তাঁরা জেনে গেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, বিভাগীয় তদন্তে তাঁরা ছাড় পান।

রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানকারী সংস্থার কাছেই যদি মানুষ নিরাপদ না মনে করে, তাহলে আসলে নিরাপত্তাটি নিশ্চিত করবে কে? সীমা ধর্ষণের ঘটনা থেকেই এই বিষয়ে বারবার শঙ্কার বিষয়টি বিভিন্ন ফোরামে উপস্থাপিত হলেও রাষ্ট্র দায়িত্বহীন আচরণ করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। সেটিকে বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ধর্ষণ। যখন রাষ্ট্রের কোনো সংস্থার সদস্য দ্বারা কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তখন সেটিকে রাষ্ট্রীয় ধর্ষণ হিসেবে অভিহিত করেই তার বিচারপ্রক্রিয়ায় দ্রুততার সঙ্গে যেতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা এবং নিরাপত্তার জায়গাটি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই ফিরে পাচ্ছে না এই দেশের মানুষ। আর এই জারি থাকা আস্থাহীনতা নানাভাবে ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। এমনিতেই এ দেশে যত ধর্ষণ ঘটে, তার খুব অংশই থানায় মামলা হিসেবে আসে। যে ক্ষুদ্র অংশ আসে, এখন সেই মানুষের মনে ভয় বেড়ে যাবে। ধর্ষণের শিকার নারী বিচার চাইতে থানায় মামলা করতে যাওয়ার ক্ষেত্র এখন বারবার ভাববেন। তাঁর মনে ভয় থাকবে—পুলিশ সদস্য কর্তৃক পুনরায় ধর্ষণের ভয়।

পুলিশের অপরাধের তদন্ত পুলিশ দিয়ে না করিয়ে কিংবা পুলিশের বিভাগীয় তদন্তের বাইরে গিয়ে তদন্তের ভার অন্যদের দিন। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসা এই মুহূর্তে সবচেয়ে দরকার। কিন্তু দরকারি কাজগুলোই কেন যেন হচ্ছে না এ দেশে!

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com