Thank you for trying Sticky AMP!!

নগরবিচ্ছেদী গানের মেঘপুরুষের বিদায়

সুবীর নন্দী। ছবি: সংগৃহীত

অকালই তো এখন। অকালে সব মৃত্যু তো অকালমৃত্যুই। আজম খান থেকে আইয়ুব বাচ্চু, শাহনাজ রহমতুল্লাহ থেকে সুবীর নন্দী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকে সৈয়দ শামসুল হক এবং শেষে আল মাহমুদের বিদায় আমাদের মনের আকাশকে নক্ষত্রহীন করে দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। এ শূন্যতা নিশ্চয়ই পূরণ হবে, কিন্তু এই অকালে আমরা মনে হয় প্রস্তুত ছিলাম না। এই আমরা কারা? এই দেশের বড়-ছোট, মহান ও তুচ্ছ সবাইকে নিয়ে যারা সুন্দর ও সক্ষম মানবজমিন তৈরি করতে চায়—তারা।

সুবীর নন্দীকে দেখেছিলাম এক বড়লোকের বাড়ির ঘরোয়া আসরে। দুঃখ পেয়েছিলাম গানের রাজাকে বিত্তের তাকিয়ায় হেলান দিতে হচ্ছে দেখে। দুই কি তিন সপ্তাহ আগে গনগনে গরমে তাঁকে দেখি পান্থপথ মোড়ে রিকশায়। রোদে তাঁর ফরসা মুখ লাল টকটকে হয়ে উঠেছিল। সঙ্গে সম্ভবত স্ত্রী ছিলেন, ওঁরা হয়তো গ্রিনরোডের দিকের কোনো হাসপাতালে যাবেন বলে মোড়ে আটকে আছেন। দূর থেকে মনে মনে সালাম দিয়েছিলাম। জানতাম তাঁর গুরুতর অসুস্থতা দেখা দিয়েছে। একবার ভাবলাম রিকশায় করে যখন যাচ্ছেন, তার মানে সুস্থ হয়ে উঠছেন। কিন্তু একের পর এক নক্ষত্রের পতনে আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছিল। তরুণ কি প্রবীণ, সবল কি দুর্বল, কতজনই এই খরখরা জীবনবিনাশী সময়ে বিদায় নিলেন। তাই কথা ভেবে মনে ধক করে উঠেছিল, আর কতজনকে আমরা অকালে হারাব? পরিসংখ্যানে উন্নতির ফিরিস্তি ছাড়া আর কোন দিকে আমরা ভালো আছি? যে দেশে জীবন জীয়ে না, সে দেশে শিল্পীরাও বাঁচেন না। রাজনীতির করুণ কঠিন বাস্তবতা আর বিবাগি মনের এই জড়াজড়ি সম্পর্ক আমরা কবে যে বুঝব?

বাংলার গানের ভরা খাতটা একটু বেশিই বিচ্ছেদী। হয়তো শোক গেলেও দুঃখ যায় না বলে, হয়তো ২/৩ পুরুষ আগে কৃষক ছিলাম বলে, ৪ দশক আগেও ধান-জলে গড়াগড়ি খেতাম বলে আমাদের মনে মায়ার টানাটানি একটু বেশিই। ঢাকার ষাটের আধুনিকতার মেঘ গানে যে বৃষ্টি ঝরাল, তা ওই বিচ্ছেদী রোমান্টিকতার নদীকেই ভরিয়ে তুলল। এই জল নতুন, এই জল সারবান আবেগবাহী, এই মন সরল কিন্তু জীবনের উদযাপনে কোনো কমতি মানে না। তুলনায় সে সময়ের কলকাতার আধুনিক গানে দুঃখের দরিয়া বইলেও তা যেন কতকটা মরকুটে, নিস্তেজ ও অবসন্ন (শচীন কর্তা, আরডি বর্মনের সুর এবং কিশোর কুমারের মতো ব্যতিক্রমী কণ্ঠ ছাড়া)। হয়তো দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু জীবনের ভার, বেকারত্ব, ভক্তিরসের অতিরেকে ওই সব গানে জীবনের লবণ কিঞ্চিৎ কম ছিল।

অন্যদিকে ষাট-সত্তর দশকে বাংলাদেশের তরুণের আন্দোলন আর গানের এই সপ্রাণ-সতেজ বিরহভাব জন্ম দিল আরেক ধারার, যাকে বলতে চাই নগরবিচ্ছেদি। গ্রামীণ বিচ্ছেদী ধারার বিবাগি কিন্তু তাজা দপদমে মন আর মধ্যবিত্তীয় ভাবভঙ্গিসুর নিয়ে এ এক সুন্দর সুরনদী। আজও তাকে পুরানা বলা যাবে না মনে হয়। কারণটা আমাদের ভাবকাঠামো আর সাংস্কৃতিক গড়নের ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত আছে। নতুন দেশ, নতুন মধ্যবিত্ত, কৃষক মন শহরে এসে বিচ্ছেদী ধারার নাগরিকায়ন ঘটাল। পরের দিকে আইয়ুব বাচ্চু, তপন চৌধুরী, বারী সিদ্দিকী, চন্দনা মজুমদারেরা এই খাতে আরো মন ঢেলেছেন। আর স্বর্ণযুগে যেমন বশীর আহমেদ, আবদুল জব্বার, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, মাহমুদুন্নবী, শাম্মি আক্তার, আব্দুল হাই আল হাদীরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন কলিম শরাফীরা। এর সবটা ভাব ও আবেগ নিয়ে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি গেয়ে উঠেছিলেন সুবীর নন্দী। সে সময় ঢাকা বেতার সারা দেশ থেকে প্রতিযোগিতা করে উঠিয়ে এনেছিল ঢাকার কিশোর কুমার অ্যান্ড্রু কিশোর আর আমাদের অজয় চক্রবর্তী সুবীর নন্দীকে। আজ কলকাতা তাঁকে নিয়ে শোক ও আন্তরিক স্মরণ না করুক, আমরা করব। আমাদের নাগরিক বিচ্ছেদী মনের এক মেঘপুরুষ আজ বিদায় নিলেন।

সুবীর নন্দী সে ধরনের শিল্পী, যাঁর লেখা গান হোক, হোক যে নায়কের অভিনয়, গলা শুনলেই মনে হবেই যে, ওই যে সুবীর নন্দী গাইছেন, কণ্ঠ ভরা বিষাদের মেঘ উগরাচ্ছেন, আর আমাদের মনে এই নিরাক পড়া দুপুরে বিনা মেঘেই গায়েবি সুরমেঘ থেকে অদৃশ্য বৃষ্টি ঝরছে। বিদায় প্রণাম দাদা।