Thank you for trying Sticky AMP!!

নতুন বাংলাদেশের সূর্য উঠেছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি

একসময় বাংলাদেশকে নিয়ে চোখের পানি ফেলেছি। এখন অবশ্য এক নতুন যুগ। ২০০০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমি খবরের কাগজে লিখতাম আমার বাবা ডা. ফজলে রাব্বীর খুনিদের বিচার চেয়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী আলবদর বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর দোষ, তিনি দেশকে ভালোবাসতেন আর দেশকে গড়ে তোলার মেধাশক্তি তাঁর ছিল। বাবা হত্যার বিচার চেয়ে প্রতিবছর জনগণ এবং সরকারগুলোর কাছে আবেদন জানাতাম। আমার আগে আমার মা ডা. জাহান আরা রাব্বী একই দাবি জানিয়ে কাগজে লিখতেন। আমরা চাইনি দেশ ভুলে যাক দেশের সূর্যসন্তানদের। ১৯৭২ থেকে ২০০০ সালে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত আমার মা এই দাবি করে গেছেন।

শেষ পর্যন্ত সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করল এবং তারপর এল শাহবাগ চত্বরের সেই আন্দোলন। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে সরকারের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দিতে ঢাকায় এসেছিলাম। বুদ্ধিজীবীদের গুম করে খুন করার অপরাধে অভিযুক্ত হলো চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। এই দুজন দণ্ডিত খুনিই এখন বাংলাদেশের বাইরে। শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা জনগণ ও আমাদের সাহসী নেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এই বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এই বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার জনগণ ও শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি প্রথম প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে।

আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষ করে নারী-শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানব উন্নয়নের অগ্রগতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার জনগণের প্রতি দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে এগোচ্ছে। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী, সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ছিল এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্যসেবায় বা জাতিগতভাবে বৈষম্য থাকবে না। একাত্তরে আমার বাবাসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বাংলাদেশকে যেখানে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সেই জায়গা থেকে আমরা দ্রুত সামনের দিকে এগোচ্ছি। আজ আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি। তবে এতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের আরও সামনে এগোতে হবে এবং এই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আমাদের সামনে রয়েছে।

পয়লা বৈশাখে আজ আমরা গানে, নাচে বিভিন্ন শিল্প এবং চারুকলায় মেতে থাকি একসঙ্গে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন ইউনেসকো থেকে স্বীকৃত। আমরা আমাদের ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে পেরেছি। ভারতের অনেক সাংবাদিক এখন বলেন যে বাংলা সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল হচ্ছে ঢাকা। ঈদ হোক, পূজা হোক বা বড়দিন—আমরা সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠি, যখন দেখি আমাদের জনপদগুলো উৎসবে মেতে ওঠে। এগুলো হলো জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের তৃতীয় প্রতিশ্রুতি পূরণ।

দেশ হিসেবে আমাদের বহু সমস্যা রয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়, সুশাসন ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে সংকট, নানা অনিয়ম-দুর্নীতি—এসব আমাদের ব্যথিত করে। কিন্তু তারপরও আমরা মিয়ানমারে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছি। শান্তিতে নোবেল পাওয়া মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি আজ বিশ্বজুড়ে নিন্দিত ও অপদস্থ হচ্ছেন। অথচ আমাদের দেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছেন। এই মানবিক আচরণের ফল নিশ্চয়ই দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পাবে।

শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর সন্তান হিসেবে আমি মনে করি, আজ নতুন বাংলাদেশের সূর্য উঠেছে। একাত্তরে দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মত্যাগের ফল মিলতে শুরু করেছে। ক্রিকেটে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমাদের তৈরি পোশাক আজ বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের নারী শ্রমিকদের বানানো পোশাক নিউইয়র্কের কোনো উৎকৃষ্ট দোকানে দেখে গর্ব বোধ করি। এখানে পৌঁছাতে আমাদের ৫০ বছর লেগেছে। দেশের সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকলে আমরা এক শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারব।

নতুন বাংলাদেশকে উপলক্ষ করে এখন আমাদের উৎসব করার সময়। চলুন আমরা এই ডিসেম্বর মাস ভালোভাবে উদ্‌যাপন করি।

ড. নুসরাত রাব্বী: শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর কন্যা, ডাটা সায়েন্টিস্ট। নিউইয়র্কে কর্মরত প্রবাসী