Thank you for trying Sticky AMP!!

নারীর শরীরবৈষম্যের ইশতেহার

প্রতীকী ছবি

এবার ৮ মার্চের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বলছে নারীর সমতা আর অধিকারের কথা। কারণ, জলবৎ তরলং। নারীর এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়ই হলো বৈষম্য আর অধিকারহীনতা। আর এর উৎস সর্বত্র—নারীর শরীর থেকে বৃহত্তর সমাজ বা রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বা সমাজ নারীর এগিয়ে চলার গতিকে তো মন্থর করে দিতে পারেই, কিন্তু নারীর নিজের শরীরও তাকে আটকে দিতে পারে বৈষম্যের জালে। এরই এক মর্মন্তুদ প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে সদ্য প্রকাশিত এক জরিপে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘প্রগতির পথে’ নামে ২০১৯ সালের একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। নীতিনির্ধারক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নকর্মীদের কাছে এই জরিপের পরিচয় ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটরস ক্লাস্টার সার্ভে’ নামে। এ জরিপের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে নারীর বৈষম্য আর অধিকারহীনতার ছবি। জীবনের প্রতি স্তরে নারীর শারীরিক বঞ্চনার প্রমাণ তথ্য–উপাত্তসহ আমাদের চোখের সামনে হাজির করেছে এটি।

জরিপটি দেখাচ্ছে, নারী উন্নয়নের কোলাহলে ভরা ২০১৯ সালে এসেও প্রায় ৩০ শতাংশ মেয়ে তাদের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই মা হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ দেশে বিয়ের আইনি বয়স ১৮। অর্থাৎ এখনো প্রতি ১০ জনে ৩ জন করে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে কিশোর বেলায়, যখন তার শরীর বিবাহিত জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত নয়, মা হওয়া তো দূরস্ত। এর চেয়েও দুঃখজনক হচ্ছে, তাদের মধ্যে আবার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ মেয়ে ১৫ বছর বয়সের আগেই মা হয়ে পড়ছে। তার মানে, এই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৩–১৪ বছর বয়সে। জরিপের ফল বলছে, পুরুষের মধ্যে জন্ম–প্রতিরোধক ব্যবহারের হার অনেক কম। অর্থাৎ বিবাহিত জীবনে শারীরিক ঝক্কি পোহানোর দায় কেবলই মেয়েটির, পুরুষের কেবলই নির্জলা ভোগের সংসার।

নারীর জীবনে বিয়ের পরবর্তী স্তর গর্ভাবস্থা। মেয়েদের জন্য এই সময়টা খুবই সংকটপূর্ণ। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ ও গর্ভকালীন যত্ন এই সংকট মোকাবিলায় সহনীয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গর্ভকালীন অন্তত চারবার চিকিৎসকের পরামর্শ ও চেকআপ অত্যন্ত জরুরি। এই পরামর্শ ও চেকআপ মেয়েদের গর্ভকালীন ও পরবর্তী শারীরিক জটিলতাকে আগেভাগে শনাক্ত করতে এবং মেয়েটির জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে। কিন্তু জরিপটি আমাদের বলছে, ১৭ ভাগ নারী একবারের জন্যও কখনো জরুরি গর্ভকালীন চেকআপে যেতে পারেননি। এ ছাড়া প্রতি তিন গর্ভবতীর দুজনই সুপারিশকৃত চারবারের চেকআপ থেকে বঞ্চিত। গ্রামীণ পরিসরে এ সংখ্যা আরও বেশি—বিশেষ করে ময়মনসিংহ, বরিশাল ও সিলেট অঞ্চলে। আর্থসামাজিক বিচারে যাঁরা সবচেয়ে পেছনের সারিতে, বৈষম্যের এ চিত্র তাঁদের মধ্যে আরও ভয়াবহ। এসব নারীর ভাগ্যে গর্ভকালীন যে চিকিৎসাসেবা জোটে, তার মানও অসম্ভব নিচু। সুপারিশকৃত গর্ভকালীন সেবার সামান্য এক ভগ্নাংশ কারও কারও কপালে জোটে, কারও কারও তা জোটেই না। ফলে ধুঁকে ধুঁকে পার করতে হয় তাঁদের নিজের জীবন। এমনকি তার পরের প্রজন্মকেও।

সন্তানের জন্মদান নারী জীবনের আরেক অধ্যায়। বৈষম্য আছে এখানেও। জরিপের পরিসংখ্যান বলছে, ৪৬ শতাংশ নারী সন্তান প্রসব করে থাকেন ঘরে। অথচ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবের সুপারিশ করা হয়েছে বহু আগেই। নিম্ন আয়ের পরিবারে প্রতি চার নারীর মধ্যে তিনজনই ঘরে সন্তান প্রসব করিয়ে থাকেন। উচ্চ আয়ের নারীদের মধ্যে এ সংখ্যা পাঁচজনের মধ্যে একজন। বেশির ভাগ নিম্ন আয়ের নারী তো সন্তান প্রসবের জন্য মানসম্মত চিকিৎসাসেবাও পান না।

জাতীয় মাতৃস্বাস্থ্য কৌশলপত্রের সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, সন্তান প্রসবের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রসব-পরবর্তী প্রথম সেবা পাওয়া প্রতিটি নারীর অধিকার। অথচ এই অধিকারটুকু ভোগ করে থাকেন মাত্র ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। নিম্ন আয়ের পরিবারের বেশির ভাগ নারীই এ অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। এ সংখ্যা ভয়ংকর। এটি পান ১০ জন নারীর মধ্যে মাত্র ১ জন।

এবার দেখা যাক নারীর অসুখ-বিসুখের তথ্য-উপাত্তে। অদ্ভুতভাবে দেখতে পাচ্ছি, নারীর অসুখের যা কিছু তথ্য বা খবর, তা কেবল গর্ভকালীন অবস্থার মধ্যেই সীমিত। ‘প্রগতির পথে’ বা বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের মতো মর্যাদাপূর্ণ জরিপও স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থায় নারীর রোগের কোনো উপাত্তই আমাদের দিতে পারছে না। জানাতে পারছে না তাঁদের পুষ্টি-অবস্থার তথ্যও। যেন নারীর শারীরবৃত্তীয় খবরাখবরের প্রয়োজন বা গুরুত্ব কেবলই তাঁর গর্ভকালীন সময়কালে।

আমরা জানি, জন্ডিস, গর্ভকালীন খিঁচুনি বা মূত্রথলির সংক্রমণের মতো কঠিন অসুখে ভোগার সংখ্যা নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের মধ্যে বেশি। তেমনই প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে এই শ্রেণির নারীদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। যাঁরা বেঁচে থাকেন, তাঁদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশকে প্রসবকালীন অথবা প্রসব-পরবর্তী জটিলতার কারণে জীবন্মৃতের মতো জীবন পার করতে হয়। সুচিকিৎসা এই নারীদের অধিকার নয়, নিয়তি। ভাগ্যে থাকলে জোটাও, নাহয় ‘ধুঁকে ধুঁকে মরো’। ভাবতে অবাক লাগে, এত সব স্বাস্থ্যনীতি, কৌশলপত্র আর সুপারিশমালা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গর্ভবতী ও প্রসূতি ছাড়া আজও সাধারণভাবে নারীদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা নেই।

বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের সীমারেখায় উন্নীত। প্রচুর নারী বেরিয়ে আসছেন ঘর থেকে। কাজে ঢুকছেন, উন্নয়নের অংশীদার হচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের বড় একটা অংশকে পার হয়ে আসতে হচ্ছে বৈষম্যে ভরা জীবনের এক একটি অধ্যায়। আর স্বাস্থ্যসেবা-বঞ্চিত নারীরা যখন এ অধ্যায়গুলোকে পার করে এসে কাজে যোগ দিচ্ছেন, তখন তাঁদের শরীর অর্ধমৃত। সমতা আর অধিকার আদায়ের দাবি তোলার মতো শক্তি তত দিনে ঝরে গেছে তাঁদের মন আর শরীর থেকে। প্রগতি আর উন্নয়নের পথে যতটা অংশীদার হওয়ার ক্ষমতা আর সম্ভাবনা ছিল, তার অনেকটাই তাঁরা খুইয়ে ফেলে এসেছেন অতি অল্প বয়সে। সমতা আর অধিকার তাই এখনো অধরাই থেকে গেছে এ দেশের নারীর জীবনে।

আসফিয়া আজিম জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী