Thank you for trying Sticky AMP!!

নারী নেতৃত্ব: আমরা কি প্রস্তুত?

মাস ছয় আগে হইচই প্ল্যাটফর্মে ‘তাসের ঘর’ নামে একটা ছবি দেখছিলাম। করোনা লকডাউনে পীড়ক স্বামীর সঙ্গে এক নারীর ঘরবন্দী জীবনের গল্প। একজন পীড়নকারীর সঙ্গে দিনরাত কাটানো কতটা দুর্বিষহ হতে পারে এবং তা একজন নারীকে কতটা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়, দেখে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল।

এ তো গেল সিনেমার কথা। বাস্তব চিত্রটা কি ভিন্ন? ২০২০ সালে কোভিডে বিশ্বজুড়েই নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে প্রতিদিন পৃথিবীতে গড়ে ১৩৭ জন নারী তাঁর পরিবারের সদস্যদের কারণে মৃত্যুবরণ করছেন।

নারীর ওপর অতিরিক্ত দায়িত্বকে নির্যাতন বলে মানতে নারাজ অনেকেই। পরিবারের কাজ কঠিন কিছু নয়, গৃহিণীদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়—ও বাসায় থাকে, কিছু করে না। সবাই জানে, কোভিডের সময় নারীর কাজের চাপ বেড়েছে। ২০১৪ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সিপিডির যুগ্ম গবেষণা বলছে স্বাভাবিক সময়ে নারী ও পুরুষের অবৈতনিক কাজের অনুপাত ছিল ১২: ২.৭। কোভিডের সময়ে এই ব্যবধানও অনেক বেড়েছে। এসবের বাইরে মহামারির সময়টিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা, নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নারীরা।

আশার কথা হচ্ছে, কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্দান্ত নেতৃত্ব দিয়েছে নারীরা। সামনের সারির লড়াই থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণ—সব ক্ষেত্রেই ছিল নারীর দৃপ্ত পদচারণা। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে চিকিৎসকদের ৬২ শতাংশ পুরুষ আর ৩৮ শতাংশ নারী। নার্সদের মধ্যে ৬ শতাংশ পুরুষ ও ৯৪ শতাংশ নারী। বলা বাহুল্য, কোভিড বিস্তার রোধে এবং অসুস্থদের সেবা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন নারী স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ের উন্নয়নকর্মীদের একটা বিশাল অংশও নারী, কোভিড-১৯ ঠেকাতে এরা সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা দিয়ে গেছেন।

অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বিপুলসংখ্যায় এগিয়ে এসেছেন নারীরা। কোভিডের সময় অনলাইনে যে পরিমাণ নারী উদ্যোক্তা দেখা গেছে এবং যেভাবে তাঁরা সেবা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, এমনটা আগে কখনোই দেখা যায়নি। হ্যাঁ, তার পেছনে অর্থনৈতিক তাড়নাটাই মুখ্য। কিন্তু এও তো মানতে হবে যে, যেকোনো সংকটে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ বা বিকল্প সমাধান নিয়ে আসাটা নারীর সহজাত গুণ।

কোভিডে ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশই নারী, যাঁদের একটা অংশের সঙ্গে আমরা কাজ করি। দেখা গেল, খুব দ্রুতই তাঁরা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত সময়ে তাঁরা প্রশিক্ষণ নিলেন, জীবিকা নির্বাহের বিকল্প পথে স্বচ্ছন্দেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

ছোট ছোট এই সব চিত্র মিলে নারীর বড়সড় একটা ছবি খুব পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। সেটা হলো তাঁদের দৃঢ় মনোবল, হার না মানার মানসিকতা এবং নেতৃত্বের সহজাত গুণ। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার এই যে ব্যাপারটা উঠে আসছে, সেটাই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যে—উইমেন ইন লিডারশিপ: এচিভিং অ্যান ইকুয়াল ফিউচার ইন আ কভিড-১৯ ওয়ার্ল্ড।

কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে আমরা যে জেন্ডার-সমতা নিয়ে কথা বলছি, সেটা নিশ্চিত করতে আসলে নারী নেতৃত্বের বিকল্প নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, বিষয়টিকে আমরা কীভাবে দেখছি? আমাদের সমাজ কীভাবে দেখছে? অস্বীকার করার উপায় নেই যে নারী অধিকার বা নারী ক্ষমতায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হবে, আমরা হয়তো পেছনের দিকে হাঁটছি, অন্তত প্রতিদিনের খবরের কাগজ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেখলে সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

মূল কারণটা কী? আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, বলব, নারীর প্রতি বৈষম্য। এটা আমাদের সমাজে এত গভীরভাবে প্রোথিত, শুধু নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে বদল করার চিন্তা করে কাজ হওয়ার আশা নেই। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি আর মানসিকতা বদলাতে না পারলে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

মানসিকতা বদলাতে কাজ করতে হবে অনেকভাবে। সবার আগে ভাবতে হবে, নারীর যে ইমেজ আমাদের মনে গড়ে উঠছে, তার উৎস কোথায়? একটা উৎস হচ্ছে বইয়ে, নাটক-সিনেমায় তুলে ধরা নারীর ইমেজ। আরেকটা হচ্ছে বন্ধুবান্ধব বা অন্য মানুষজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করে। বাড়িতে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যে রকম সম্পর্কের নানা মাত্রা আমরা দেখি, সেটাও আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে।

মানসিকতার বদলে নারীর এই পজিশনিং বা উপস্থাপনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারীর এই নেতৃত্বের গল্পগুলো উঠে আসা প্রয়োজন। সেটা হতে পারে ঘরোয়া আলাপে, হতে পারে গল্প, নাটক, সিনেমায় উপস্থাপনে, হতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায় নারী নেতৃত্বের উদাহরণগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। একই সঙ্গে দরকার বিভিন্ন খাতে যেসব নারী কাজের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, তাঁদের কথাগুলো সবাইকে জানানোর সুযোগ করে দেওয়া।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২১ এর নানা কার্যক্রমে এই উদাহরণগুলোকে তুলে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে ইউএন উইমেন। কোভিডের প্রেক্ষাপটে, তৃণমূল থেকে নীতি নির্ধারক পর্যায়ে বিভিন্ন খাতের সেই সব লড়াকু নারীদের গল্পগুলো নিয়ে একটি সিরিজ করতে যাচ্ছে ইউএন উইমেন। ফেসবুকের সঙ্গে যৌথভাবে ২০টি গল্প ও ৩টি আন্ত-প্রজন্ম সংলাপে তুলে ধরা হবে এই নারীদের নেতৃত্বের সেই জায়গাগুলো, যা আমাদের মানসিকতার বদলে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে।

মানসিকতা বদলের শুরু করাটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রশ্ন হচ্ছে, চ্যালেঞ্জটা নিতে আমরা, আমাদের সমাজ কি প্রস্তুত?


শারারাত ইসলাম ইউএন উইমেন বাংলাদেশের কমিউনিকেশনস অ্যানালিস্ট