Thank you for trying Sticky AMP!!

নির্বাচনের পঞ্চাঙ্ক নাট্যাভিনয়

একবার ভারতের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় আমি সে দেশে  ছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার নির্বাচনও জাতীয় নির্বাচনের মতোই বিরাট আয়োজন। গিয়েছিলাম কলকাতার কিছু দূরে উত্তরপাড়া। সেখানে জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ ছিল। এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন এক পরাজিত প্রার্থী তাঁর সমর্থকদের নিয়ে। তিনি বৃদ্ধ দোকানিকে সালাম দিলেন। দোকানি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘কী করবে বাবা, সবই ভগবানের লীলে।’

পরাজিত প্রার্থীর এক সঙ্গী ওই বৃদ্ধের কথায় বিশেষ খুশি হলেন না। তিনি ফোড়ন কাটলেন, ‘যে জিতেছে তার জন্য তো লীলাই। শোনেন জ্যাঠা, নির্বাচন কোনো লীলাখেলা না।’

আসলেই নির্বাচন কোনো লীলাখেলা নয়। বিশেষ করে বঙ্গীয় নির্বাচনে বিধাতার করার কিছুই নেই। এখানে বিধাতার চেয়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের ভূমিকা প্রধান।

বঙ্গীয় নির্বাচন হলো নাটকবিশেষ। তবে একাঙ্কিকা নয়, পঞ্চাঙ্ক নাটক। সে নাটকও মেলোড্রামা। আবেগ, উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ। একদিকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের চিত্তচাঞ্চল্যের অন্ত নেই; অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মনোজগতের খবর ফ্রয়েড বা ইয়ুংদের চেয়ে বড় মনোবিজ্ঞানীর পক্ষেও অনুধাবন করা অসম্ভব। বিধিবিধান কী বলে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিটার্নিং কর্মকর্তার মন কী বলে। মনোনয়নপত্র মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করার আগে তিনি তাকিয়ে দেখেন প্রার্থীটি কে।

যদি তিনি মনে করেন এই প্রার্থীর নির্বাচনে না দাঁড়ানোই ভালো, তাহলে তাঁর নমিনেশন পেপার পত্রপাঠ বাতিল করে দেন। সেটা হলো পঞ্চাঙ্ক নাটকের প্রথম অঙ্ক। বলতে গেলে প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় অংশ।

প্রথম অংশটি হলো প্রার্থীর বাসভবন থেকে নির্বাচন কমিশন অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার পর্বটি। যে কাজটির জন্য জনা তিনেক লোকই যথেষ্ট, তার জন্য নিযুক্ত হয় তিন শতাধিক। তারা কেউই হেঁটে যাওয়ার পাত্র নয়। ইতিমধ্যে যারা মোটরসাইকেল পায়নি তাদের জন্য বরাদ্দ করা হয় আরও বড় গাড়ি। মালবাহী ট্রাক। শবাধারের পেছনে যেমন ট্রাকে চড়ে মানুষ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যায়, মনোনয়ন যাত্রাও অনেকটা সে রকম। তবে বিরাটত্বের দিক থেকে অনেক শবযাত্রার চেয়ে মনোনয়ন শোভাযাত্রা আরও বড়।

বাংলাদেশসহ গণতান্ত্রিক দেশ বহু। সেসব দেশে নির্বাচন হয়। বিশ্বের কোথাও কোনো নির্বাচনে এত বেশি মনোনয়নপত্র বাতিল হয় কি না, জানা নেই। তবে যেকোনো বিবেচনায় এবারের মনোনয়নপত্র বাতিল রেকর্ড তৈরি করেছে। এই রেকর্ডের কারণ কী? দোষ কার? মনোনয়নপ্রত্যাশীর নাকি রিটার্নিং কর্মকর্তার? নাকি যে দলের হয়ে প্রার্থী মনোনয়নপত্র  জমা দিয়েছেন তঁার?

সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তাঁরা পথেঘাটের মানুষ নন। তাঁদের বলা হয় আইনপ্রণেতা। আইন রচনা অতি সূক্ষ্ম ব্যাপার। যাঁরা সংসদে আইন বানাবেন অথবা পুরোনো আইন সংশোধন করবেন, তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা স্রেফ বোকামি। মনোনয়নপত্র পূরণ করার কাজটি অতি সহজ। এত বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপত্র যে বাতিল হলো, সে জন্য শুধু রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। ছোট হোক বড় হোক, ত্রুটি নিশ্চয়ই ছিল। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিঃসন্দেহে যোগ্য মানুষ; কিন্তু এভাবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াটা তাঁদের অযোগ্যতা না হলেও অমনোযোগিতা প্রমাণ করে। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে গিয়ে যদি এই হারে বাতিল হতো, তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়াত হাজার পঞ্চাশেক। দশম শ্রেণির ছাত্রদের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটে না। কী কী কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে তা সম্ভাব্য প্রার্থীদের খুব ভালো জানা—ভোটাররা না জানলেও।

প্রার্থীর স্বাক্ষরের গরমিল কোনো গুরুতর বিষয় নয়, যতক্ষণ না প্রার্থী নিজে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যে ব্যক্তি ঋণখেলাপি তা তাঁর চেয়ে বেশি দুনিয়ার আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বিশেষভাবে ম্যানেজ না করে খেলাপি ঋণের দায় নিয়ে নির্বাচন করতে যাওয়া যায় না, তা প্রার্থীদের অজানা নয়। খেলাপি ঋণও থাকবে, নির্বাচনও করবেন—এটা সম্ভব নয় জেনেও মনোনয়ন ফরম কিনে তা জমা দিতে যাওয়ার মধ্যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয়ই পাওয়া যায়। যদিও বাংলাদেশে যাঁরা ঋণখেলাপি, পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যে পড়েন তাঁরা।  

নির্বাচনী নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে ছিল মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া আবেদনকারীদের আপিল নিষ্পত্তি। আপিল করেছিলেন ৫৪৩ প্রার্থী। ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ২০৪ জন। যাঁরা প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই বিভিন্ন বিরোধী দলের অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী। জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে বিধান করা হয়েছে তা গণতন্ত্রসম্মত নয়। ওই বিধি করার সময় নাগরিক সমাজ থেকে যখন মতামত চাওয়া হয়েছিল, আমি তাতে লিখিতভাবে আপত্তি করেছিলাম। দলীয় রাজনীতি করেন না, এমন বহু যোগ্য লোক দেশে রয়েছেন। তাঁদের দেশসেবায় এই বিধি বড় বাধা।

চীন দেশে একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘তরমুজের খেতের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় জুতার ফিতা বাঁধতে যেয়ো না।’ দূর থেকে দেখে কেউ সন্দেহ করতে পারে যে লোকটি তরমুজ চুরি করছে। বিরোধী দলের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী যাঁরা সরকারি জোটের প্রার্থীর জন্য হুমকি, তাঁদের মনোনয়নপত্র যখন তুচ্ছ কারণে বাতিল হয়, তখন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সন্দেহ করলে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। আপিল নিষ্পত্তির বিষয়টি ছিল আমাদের নির্বাচনী নাটকের তৃতীয় অঙ্ক।

চতুর্থ অঙ্ক হলো প্রার্থিতা চূড়ান্তের পর প্রচারাভিযান। আচরণবিধি লঙ্ঘন কাকে বলে এবং কত প্রকার তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে জনগণ। এই দৃশ্য শুধু বিরক্তির নয়, বিশেষ উপভোগ্য। এই অংশে বহু প্রার্থী বিদূষক বা ভাঁড়ের ভূমিকায় অভিনয় করে টিভি দর্শকদের হাসাবেন। শেষ অঙ্কটি হলো নির্বাচন গ্রহণ। সেই অংশে ফাইটিংয়ের দৃশ্য থাকতে পারে, না–ও পারে। সেই দৃশ্যে অভিনেতা–অভিনেত্রীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বস্তু—ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স। ওই দুটি জিনিসের যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, তাহলে তারাই ভালো বলতে পারত ভোট কেমন হলো, কোনো পর্যবেক্ষকের বা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদকের প্রয়োজন হতো না।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী নাট্যাভিনয়। সংবিধান সংশোধন করেছে বর্তমান সরকারই। সব প্রধান দলই এই সংশোধনীর ঘোরতর আপত্তি করেছিল। মানুষের মধ্যে আস্থা ফেরাতে অন্তত আরও দুটি নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার পরামর্শ উচ্চ আদালতও প্রথম দিয়েছিলেন। যাহোক, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দোষের নয়। খুবই দোষের হলো নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ভালো-মন্দের দায় শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়, সরকারেরও। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব তা প্রমাণ করার প্রথম ও শেষ সুযোগ একাদশ জাতীয় নির্বাচন। সেই সুযোগ নষ্ট হলেও সরকার গঠিত হবে, রাষ্ট্র চলবে, স্কুল-কলেজ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অফিস–আদালত চলবে, অর্থাৎ দেশের দেহটা থাকবে কিন্তু মৃত্যু ঘটবে জাতির আত্মার।  

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক