Thank you for trying Sticky AMP!!

নৈতিকতা ও আইনের দৃষ্টিতে বিচারকের মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীর ধর্ষণ মামলায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর মাননীয় বিচারক মোসাম্মাত কামরুন্নাহার গত বৃহস্পতিবার যে রায় দিয়েছেন, সে বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। কারণ, রায় আমি এখনো দেখিনি।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। এ মামলায় ওই বছরের ৮ জুন পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। পরের মাস অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৪৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনকে আদালতে হাজির করা হয়।

বাদীপক্ষের আইনজীবী ইতিমধ্যে বলেছেন, তাঁরা এই রায়ে অসন্তুষ্ট ও উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। কিন্তু রায় প্রদানকালে বিচারক যেসব মন্তব্য করেছেন, তা অবান্তর। এই মন্তব্যে ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই প্রকাশ পেয়েছে। কোনো বিচারক পুলিশকে বলতে পারেন না তারা কত দিন পর মামলা নেবেন বা নেবেন না। কারণ, ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সময় বেঁধে দেওয়া নেই। ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না।

দ্বিতীয়ত, বিচারক ভুক্তভোগীদের সম্পর্কে ‘সেক্সুয়ালি হ্যাবিচুয়েটেড’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা-ও অত্যন্ত আপত্তিকর। এ কথা চিকিৎসক তাঁর মেডিকেল রিপোর্টে কেবল লিখতে পারেন; বিচারক কখনো এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। বিচারাঙ্গন অত্যন্ত পবিত্র স্থান। কে সেক্সুয়ালি হ্যাবিচুয়েটেড, সে সম্পর্কে বিচারক মন্তব্য করতে পারেন না। বিচারকের আসন থেকে এমন মন্তব্য সমীচীন নয়, যাতে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রকাশ পায়।

আমাকে এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছেন, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বিরাজ করছে, তারই প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি এই রায়ে। বিচারকের আসনে একজন নারী থাকলেও তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকাশিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিচারক যে সুপারিশ করলেন, ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা নেওয়া যাবে না, এটা তিনি বলতে পারেন না। এতে ভুক্তভোগীদের বিচার চাওয়ার পথ যেমন সংকুচিত হয়ে যাবে, তেমনি উৎসাহিত হবে অপরাধী তথা ধর্ষকেরা। এই অবস্থা সমাজে আইনের শাসনের সহায়ক নয়।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত কিংবা আইনসভায় গৃহীত আইনের গুণাগুণও বিচার করে থাকে বিচার বিভাগ। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্বও সবার। মাননীয় বিচারককেও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না

২০১৫ সালে এক গারো মেয়ে মাইক্রোবাসে ধর্ষণের শিকার হন। এই খবর পত্রিকায় দেখে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা আদালতের নজরে আনেন। সেই মামলায় আমি বাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলাম। হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও ইজহারুল হক আকন্দের বেঞ্চ যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অধস্তন আদালত তা মেনে চলতে বাধ্য। রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায় বিচারক যে মন্তব্য করেছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক এবং দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী। মনে রাখতে হবে, বিচারকও আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাঁকে আইনের মধ্যে থেকেই বিচারকাজ করতে হয়; তিনি এর বাইরে যেতে পারেন না।

আমি আগেই বলেছি, ফৌজদারি অপরাধ কখনো তামাদি হয় না। যদি হতো, ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার হতো না এবং অপরাধীরা শাস্তিও পেতেন না। ১৯৭১ সালে যাঁরা এ দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার হয়েছে আরও পরে। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে হত্যা ছাড়া ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো গুরুতর অপরাধেরও অভিযোগ ছিল। অতএব, ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের অভিযোগে কারও বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না—বিচারকের এই মন্তব্য কেবল নৈতিকতার দৃষ্টিতে নয়, আইনের দৃষ্টিতেও অগ্রহণযোগ্য। কেবল আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষণকে অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিচারকের মন্তব্য সমাজে ইতিমধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। দেশের অনেক আইনজীবী তাঁর মন্তব্যের অসারতা তুলে ধরেছেন। নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, উচ্চ আদালত এই বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেবেন। আদালত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দৃষ্টি না দিলে যেকোনো নাগরিকও আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির প্রতি সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সব বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং হাইকোর্ট বিভাগের সব বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।। নিম্ন আদালতের যেকোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিতে পারেন। সম্প্রতি নড়াইলের এক সেশন জজের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

আইনজীবী হিসেবে ৪১ বছর ধরে আদালত অঙ্গনে আছি। বিচারপ্রার্থীরা এখানে আসেন ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য। আদালত সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করেন। অভিযোগের পক্ষে তদন্তকারী কর্মকর্তারা অকাট্য তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে না পারলে আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারেন। এই মামলায়ও বিচারকও সে কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তা নিন্দনীয়। আমরা যখন আইনের শাসনের জন্য লড়াই করছি, তখন এ ধরনের মন্তব্য বা সুপারিশ বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে হতাশা ও আদালতের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে।

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত কিংবা আইনসভায় গৃহীত আইনের গুণাগুণও বিচার করে থাকে বিচার বিভাগ। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্বও সবার। মাননীয় বিচারককেও এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

জেড আই খান পান্না সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি