Thank you for trying Sticky AMP!!

ন্যায়বিচার ও রিমান্ড

.

একটি সভ্য সমাজের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিষয় ন্যায়বিচার। কেননা, ন্যায়বিচারবঞ্চিত সমাজের শান্তি, সভ্যতা ও প্রগতি এক কথায় মানবজীবনে কোনো উৎকর্ষতা থাকে না। তাই যেকোনো সভ্য সমাজের জন্য ন্যায়বিচার অপরিহার্য। আর এর জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন। লর্ড চ্যাথাম বলেছেন, ‘আইন যেখানে শেষ, সেখানেই অত্যাচার শুরু।’
ন্যায়বিচার পাওয়ার পূর্বশর্ত যেমন ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও দক্ষ বিচারক; তেমনি বিশেষ করে ফৌজদারি মামলায় সত্যিকার দোষী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। একটি ফৌজদারি মামলায় যিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা থাকেন, তাঁর সততা ও দক্ষতা দোষী ব্যক্তিকে উপযুক্ত সাক্ষ্য–প্রমাণ দ্বারা শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ ভূমিকা থাকে। কিন্তু গণতন্ত্রবিহীন একটি দেশে যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পেশাগত দায়িত্ব ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবান্বিত হয়, তখন অনেক সত্যিকার দোষী ব্যক্তি আইনের আওতায় আসেন না এবং নির্দোষ ব্যক্তি সাজানো সাক্ষ্য–প্রমাণের কারণে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। ফলে একদিকে যেমন জনগণ বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা হারায়, অপর দিকে দোষী ব্যক্তিরা সমাজে নির্বিচারে তাঁদের জঘন্য কর্মকাণ্ড চালাতে সক্ষম হন। ফলে স্বাভাবিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, জনগণের জানমাল বিপন্ন হয়।
এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অদক্ষতা এবং অসৎ পথে অর্থ উপার্জনের উৎস হিসেবে ফৌজদারি মামলায় তদন্তের ক্ষেত্রে তাদের সঠিক ভূমিকা রাখে না। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যিকার দোষী ব্যক্তিদের আড়াল করার জন্য অনেক নির্দোষ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে এবং নির্যাতনের ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তার শেখানো মতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে কথিত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে—জনগণকে এই ধারণা দিয়ে তাদের ব্যর্থতা এবং অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করে।

ন্যায়বিচার পাওয়ার পূর্বশর্ত যেমন ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও দক্ষ বিচারক; তেমনি বিশেষ করে ফৌজদারি মামলায় সত্যিকার দোষী ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর

এ ক্ষেত্রে তদন্তকালীন যখন কোনো মামলায় আসামিকে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করে পুলিশ রিমান্ড চায়, তখন ওই বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের একটি বিরাট আইনগত দায়িত্ব থাকে। এবং তাঁর ওপর নির্ভর করে একজন নিরীহ মানুষকে রিমান্ডে নিয়ে যাতে নির্যাতনের শিকার হতে না হয় এবং নির্যাতনের ফলে পুলিশের শেখানো মতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য না হয়। এ ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে, তদুপরি আমাদের উচ্চ আদালতেরও রিমান্ড-সংক্রান্ত ব্যাপারে বিভিন্ন মামলায় নির্দেশনা রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শফিউজ্জামান বনাম রাষ্ট্র গং ৫৬ ডিএলআর পৃ. ৩২৪ মামলায় বিচারপতি এস কে সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি শরিফউদ্দিন চাকলাদার সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ রিমান্ড প্রদান–সংক্রান্ত ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪, ৬০, ৬১ ও ১৬৭ ধারা এবং আমাদের সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের আলোকে নিরীহ নাগরিকেদের ফৌজদারি মামলায় আসামি হিসেবে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যখন হাজির করা হয়, সেই মামলার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে পুলিশের চাহিদামতে রিমান্ডে দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের অবশ্য পালনীয় বিষয় ওই মামলার আলোকে ১১টি নির্দেশনা দিয়েছেন।
‘ক) যখন কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করিবেন, তখন গ্রেপ্তারের কারণ উল্লেখপূর্বক একটি বিবরণ
তৈরি করিয়া তাৎক্ষণিকভাবে উহাতে গ্রেপ্তারের তারিখ ও সময় উল্লেখপূর্বক গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর নিবেন এবং তাঁর নিকটস্থ কোনো আত্মীয় অথবা বন্ধুকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞাত করিবেন।
‘খ) তাঁহার ডায়েরিতে গ্রেপ্তারের কারণ, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি কাহার হেফাজতে আছেন উল্লেখ করিবেন।
‘গ) ওই সকল বৃত্তান্তসহ বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পুলিশ হেফাজতে (রিমান্ডে) রাখার আবেদন করিতে হইবে। (ধারা-১৬৭ ফৌ. কার্যবিধি অনুযায়ী) এবং বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ডায়েরি দেখিতে মামলার তদন্তের স্বার্থে সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহের জন্য পুলিশকে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের সময় দিতে পারিবেন এবং রিমান্ডের সময় অতিক্রমের পর অবশ্যই আসামিকে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করিতে হইবে।
‘ঘ) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পুলিশ রিমান্ড অথবা জেলে প্রেরণের পূর্বে অবশ্যই তাঁহার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের করিতে হইবে। যদি কোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ওপরে বর্ণিত বিবরণসহ পুলিশ কর্মকর্তা তাঁহাকে পুলিশ হেফাজতে রাখার আবেদন করেন, কিন্তু পুলিশ ডায়েরিতে তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত যথোপযুক্ত সাক্ষ্য–প্রমাণ উল্লেখ না থাকিলে সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে যদি তাঁহার বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে মামলা–সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনো উপযুক্ত সাক্ষ্য–প্রমাণ আসার সম্ভাবনা থাকে, তখন তিনি পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী মামলা আমলে নেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির হইবেন মর্মে ফৌ. কার্যবিধি ১৬৯ ধারা মোতাবেক মুচলেকা নিয়া মুক্তি দিবেন।
‘ঙ) যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কোনো মামলার আসামিকে যিনি ইতিমধ্যে জেলে আছেন, তাঁহাকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে চান, তাহলে তাঁহাকে অবশ্যই বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট নতুন মামলাসংক্রান্ত ডায়েরিসহ উপস্থাপন না করিলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত মামলায় গ্রেপ্তারের অনুমতি দিবেন না।
‘চ) একজন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যখন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে উপস্থিত করিয়া পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করিবে, তখন অবশ্যই বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে উপরিউক্ত নির্দেশনাবলি পালিত হইয়াছে কি না, সেই মর্মে সন্তুষ্ট হইয়া প্রয়োজন বোধে রিমান্ডের আদেশ দিবেন। উপরিউক্ত নির্দেশনাবলির মূল লক্ষ্য যাহাতে কোনো নির্দোষ ব্যক্তি অযথা হয়রানির শিকার না হন।’
ওই রায়ে মাননীয় বিচারপতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করিয়াছেন যে উপরিউক্ত নির্দেশনাবলি যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা অথবা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট পালন করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁরা আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তিযোগ্য হইবেন এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ওই ব্যাপারে মহামান্য হাইকোর্টে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের শরণাপন্ন হতে পারবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওই নির্দেশনাসমূহ প্রায় ক্ষেত্রেই পালন করা হয় না; যা শুধু আইনের ব্যত্যয় নয়, উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতি অবজ্ঞার সমতুল্য, যাহা আদালত অবমাননারও শামিল।
রিমান্ডের নামে পুলিশের হেফাজতে কোনো আসামিকে যাতে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে না হয়, সে কারণে আমাদের উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো পালন করা উচিত। তদুপরি আসামিকে রিমান্ডে নেওয়ার আগে এবং তাঁকে যখন রিমান্ড থেকে আদালতে আনা হয়, উভয় ক্ষেত্রে তার ওপর কোনো শারীরিক নির্যাতন হয়েছে কি না, তার জন্য বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনা দেওয়া একান্ত আবশ্যক। তাহলে দেখা যাবে, অনেক নিরীহ ব্যক্তি একদিকে যেমন পুলিশ কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হবেন না, অপর দিকে পুলিশের শেখানো মতে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হবেন না।
বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট যখন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন, তখন স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মিথ্যা স্বীকারোক্তি করার কারণে একজন নির্দোষ ব্যক্তির জীবনে নেমে আসতে পারে চরম দুর্ভোগ, এমনকি দীর্ঘ কারাবাস ও মৃত্যুদণ্ড। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে একজন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের যে মানবিক ও আইনি দায়িত্ব রয়েছে, তা পালনে অবশ্যই সতর্কতার দাবি রাখে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন: সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।