Thank you for trying Sticky AMP!!

পদাবনত শিক্ষকেরা ক্লাসে যাবেন কীভাবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিভিন্ন গণমাধ্যমে নাম ও বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে খবরটি এসেছে। এর মৌলিক বিষয় দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষককে গবেষণাপত্রে নকল করায় বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে একজনের পিএইচডি ডিগ্রি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সর্বোচ্চ সংস্থা সিন্ডিকেট। এর আগে অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়েছে। পাঠানো হয়েছে দুটো ট্রাইব্যুনালে। সেসব তদন্ত বিবরণীর প্রাপ্ত তথ্য ও ট্রাইব্যুনালের সুপারিশ অনুসারে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনাটি গণমাধ্যমের সহায়তায় স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ দেশের সচেতন মহল অবগত।

সিদ্ধান্ত হয়েছে তাঁদের দুজনের এক ধাপ পদাবনতি। একজন প্রভাষকের নিচে কোনো পদ নেই। তাই তাঁর পরবর্তী পদোন্নতি দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থ দাঁড়ায়, তাঁরা রইলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ক্লাস করবেন। প্রশ্নপত্র তৈরি ও খাতা মূল্যায়নও করবেন পরীক্ষার্থীদের। তাঁদের পরীক্ষা চলাকালে কেন্দ্রে পর্যবেক্ষকের দায়িত্বও পালন করতে হবে। এ ধরনের ঘটনা অভিনব, এমন নয়। মাঝেমধ্যে দু-একটি আমাদের সামনে আসে। আমরা হই বিচলিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মজীবন সুদীর্ঘ ৬৫ বছর। আর তাঁরা সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত হয়ে যান খুব দ্রুতলয়ে। এখানে এ শাস্তি তাঁদের কর্মজীবনের ধারাবাহিকতায় বড় কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। তবে গুরুতর প্রভাব রাখল নৈতিক দিক বিবেচনায়। নৈতিকতার অবক্ষয় সমাজের অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে রয়েছে এর ছাপ। তবে গবেষণাপত্রে নকলের মতো বিষয়াদি নৈতিকতার মানদণ্ডে সর্বনিম্ন স্তরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন উচ্চ মেধাবীরা। ইদানীং রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগে কিছু হেরফের হওয়ার কথা জানা যায়। তবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরাও অবশ্যই মেধাবী। হয়তোবা অধিক মেধাবীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক কম মেধাবীরা স্থান করে নেন কোনো না কোনো খুঁটির জোরে। তবে প্রকৃতপক্ষে মেধাই তাঁদের কর্মজীবনের প্রধান হাতিয়ার, এটা বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁরা প্রতিনিয়ত এর চর্চা করেন শ্রেণিকক্ষে, প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ক্ষেত্রে। এসব দিক বিবেচনা করলে আলোচ্য অভিযোগটি গা শিউরে ওঠার মতো।

শিক্ষকেরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে একটি ভিন্ন ধরনের মর্যাদায় আছেন। তাঁদের পদের স্তর কিংবা মাইনে দিয়ে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা হতো না আগে। ইদানীং তাঁরাই সেদিকে অধিকতর মনোযোগী হয়েছেন। সেটাও দোষের নয়। তবে কালিমালিপ্ত নৈতিক মানদণ্ডের শিক্ষকদের নিয়ে আমরা কী করব? তাঁরা তো ছাত্রদের সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবেন না বলে অনেকেই মনে করেন। বরং ক্ষেত্রবিশেষে ভুগবেন হীনম্মন্যতায়। সেই শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষ বা পরীক্ষার কেন্দ্রে কতটা কার্যকর হবেন, এটা ভেবে দেখার বিষয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি কিংবা উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়িত্ব তাঁদের কাছে দেওয়া সমীচীন হবে কি না, এটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রশ্ন থাকে, এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য আলোচিত শাস্তি কি পর্যাপ্ত? এটা বিনা ছুটিতে বিদেশে দীর্ঘকাল অবস্থান–জাতীয় অপরাধ নয়। অপরাধ হচ্ছে নিজেদের গবেষণাপত্রে অন্যদের গবেষণালব্ধ ধারণা কোনো সূত্র উল্লেখ না করে বড় পরিসরে সংযোজন করার। পরীক্ষার হলে, এমনকি ভর্তি পরীক্ষার সময় এমনটা কোনো ছাত্র করলে কী করা হয়, এটা সবার জানা। তুলনামূলকভাবে অনেক কম বয়সী এবং কম মেধাবীর ক্ষেত্রে যদি তা-ই হয়, তবে এত বড় একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগটি নমনীয়ভাবে দেখা হয়েছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে। এ নমনীয়তার পেছনে যুক্তি কী, তা আমাদের অজানা। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা বর্ণিত অপরাধ হঠাৎ করে, কারও চাপে পড়ে কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে করেছেন, এমনও বলা যাবে না। বরং স্বীয় স্বার্থে ও দুর্লোভের বশবর্তী হয়েই এমনটি করা হয়েছে। তাই সাজার পরিসরও সর্বোচ্চ হওয়াই যথার্থ ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত। নিয়োগ থেকে শুরু করে চাকরিচ্যুতি—সবই এক কর্তৃপক্ষের অধীন। আর সে কর্তৃপক্ষে মূলত শিক্ষকদেরই প্রাধান্য। সুতরাং নিয়মকানুন অনেকাংশে তাঁদের দ্বারা প্রণীত হয়। সেখানে তাঁদের স্বার্থ গুরুত্ব পায়, এটাই স্বাভাবিক। নতুন বিভাগ সৃষ্টি বা পদ সৃজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন নেওয়ার বিধান থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করা হয় না বলে আমরা সময়ে সময়ে গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি। প্রতিটি বিভাগে আগের বিভাগীয় প্রধান পদ্ধতি নেই। সেই পদটি ছিল কর্তৃত্বসম্পন্ন। কিন্তু এখন প্রতি বিভাগে চেয়ারম্যান হন ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে। সহকারী অধ্যাপকও তা হতে পারেন। সুতরাং এটা নিছক একটি দুর্বল সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে।

ডিনরাও শিক্ষকদের দ্বারা নির্বাচিত। ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিযুক্তির জন্যও যে সিনেট সুপারিশ করে, সেখানেও শিক্ষকদের কর্তৃত্ব অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক। একটি স্বাধীন দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমনটা হওয়াই যৌক্তিক বলে মনে করা হয়। সে অবস্থায় শিক্ষকদের মনমানসিকতা ও নৈতিক অবস্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হওয়া প্রয়োজন। তরুণ ছাত্ররা অনেকটা আবেগপ্রবণ। অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের ফলে ক্যাম্পাসে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা শিক্ষকদের একটি কঠিন কাজ। এসব কাজ করার জন্যও নেতৃত্বের গুণাবলিসম্পন্ন দৃঢ় চরিত্রের শিক্ষকদেরই প্রয়োজন বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শিক্ষকেরাই তা করেন নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও সহমর্মিতার মাধ্যমে। সে জন্যই কোনো শিক্ষাঙ্গনে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকটি কঠোরভাবে দেখা আবশ্যক। এখানে ঝাড়ফুঁকের মতো ওষুধে কাজ হবে না। প্রয়োজন ছিল শল্যচিকিৎসার।

এককালের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছিল কিংবদন্তির কল্পকথার মতো। শিক্ষক ছাত্রকে পাঠদানের পাশাপাশি সর্বতোভাবে তার মঙ্গলের জন্য থাকতেন সচেষ্ট। ছাত্ররাও ছিল শিক্ষক-অন্তঃপ্রাণ। শিক্ষকদের দু-একটি বিচ্যুতিও তারা পরিহার করত। হয়তোবা এমনই কোনো প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিল একটি পদ্য:

‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়

তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।’

সে নিত্যানন্দ রায়সদৃশ শিক্ষকেরা এখন তেমন নেই। তাঁর ছাত্রদের গুরুর শুঁড়িবাড়ি যাওয়ার মতো দোষের কাজ নজরে পড়লেও অশ্রদ্ধা করেনি। তবে দিনকাল বদলেছে। সে ছাত্রও এখন আর পাওয়া যাবে না। তারা বস্তুবাদী জগতে আবেগকে বাদ দিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। তাই ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও আস্থা ধরে রাখতে নিজের মেধা ও শ্রমের পাশাপাশি শিক্ষকদের আচরণের বিষয়েও আরও সতর্ক হওয়া দরকার।


আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

majumderali1950@gmail.com