Thank you for trying Sticky AMP!!

পরীক্ষা নিয়ে যত কাণ্ড!

নতুন সরকারের নতুন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষা নিতে গিয়ে বেশ ফ্যাসাদে পড়েছেন। শুরুটাই ভালো হলো না তাঁর। প্রথম দিনেই বাংলা প্রথম পত্রে দেশের নানা স্থানে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষার্থীরা কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছে, আশাহত হয়েছেন অভিভাবকেরা। ২০১৭-১৯ শিক্ষাবর্ষের অনেক পরীক্ষার্থী ২০১৬-১৮ সনের প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে গিয়ে এই মসিবতে পড়ে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য বসে থাকেনি। তাৎক্ষণিক বিচারে কতল করেছে কেন্দ্রসচিবদের। ন্যায্য শাস্তিই তাঁরা পেয়েছেন। কিন্তু যাঁরা এ ভুলের সূত্রপাত করেছেন অর্থাৎ যাঁদের কারণে এসব ভুল হতে পেরেছে, তাদের বিষয়ে কোনো পক্ষের কোনো আওয়াজ আমি অন্তত শুনিনি।

আমি একটি ছোট্ট বিষয় উত্থাপন করতে চাই। এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় শুধু বাংলা বিষয়ে মোট তিন সেশনের প্রশ্ন করতে হয়েছে প্রত্যেক বোর্ডকে। পত্রিকাগুলো যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯—এই তিন বছরের ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নিতে হয়েছে। আর তাতেই এই গোল বেধেছে।
আমার খুব জানার ইচ্ছা করে, ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের পরীক্ষার্থীদের জন্য তিন-তিনটা আলাদা সিলেবাস করতে হলো কেন? কারা সেটা করেছেন? কোন অভিপ্রায় থেকে করেছেন?
সবাই জানেন, শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু অনেকেই এটা জানেন না, সিলেবাস শিক্ষা বোর্ড প্রণয়ন করে না। সেটা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি। তাদের কাছে কি জাতি জানতে চাইতে পারে, ২০১৬ থেকে ২০১৯—এই চার বছরে কী এমন জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয় যে তিন-তিনবার সিলেবাস পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হয়েছে? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি যত দূর জানি, দুনিয়ার কোনো দেশে যখন-তখন সিলেবাস পরিবর্তন/সংশোধন করা হয় না। একটি সিলেবাস প্রণয়নে যেমন অন্তত বছর পাঁচেক সময় গবেষণা করা হয়, তেমনি যেকোনো সামান্য পরিবর্তনের জন্যও অন্তত বছর পাঁচেক তো বটেই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক দশকেও সিলেবাসে হস্তক্ষেপ করা হয় না।

যদি মাত্র চার বছরে আমাদের সিলেবাস তিনবার সংশোধন/পরিমার্জন করার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট কর্তাদের এটা স্বীকার করতে হবে, সিলেবাস প্রণয়নে তাঁরা নিদারুণ ব্যর্থ ছিলেন বলেই এই কাণ্ড ঘটতে পেরেছে। কী সেই ব্যর্থতা? তাহলে কি অযোগ্য ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছিল সিলেবাস প্রণয়নে? কে, কোন ক্ষমতা বলে সেসব অযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন? এ জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা সম্ভবত সঠিকভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারিনি। শিক্ষার মস্তিষ্ক কারিকুলাম, সিলেবাস। একটি সুচিন্তিত, যুগোপযোগী কারিকুলামই নির্ধারণ করবে আগামী প্রজন্ম কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দেবে। আর সিলেবাসে বিন্যস্ত থাকে কোন শ্রেণিতে শিশুকে কোন বিষয়ে কতটুকু শেখাতে হবে। সে কারণে পৃথিবীর সব দেশে কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়নে খোঁজ করা হয় সবচেয়ে দূরদর্শী এমন কিছু শিক্ষাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদকে, যাঁরা অন্তত পরবর্তী ৫০ বছরকে সামনে রেখে স্বপ্ন দেখতে জানেন। এ জন্য সরকার তার সব সামর্থ্যকে উজাড় করে কারিকুলাম স্পেশালিস্ট টিম গড়ে তোলে। নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে তাঁরা আগামী প্রজন্মের জন্য এমন এক দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করেন, যা জাতিকে সত্যিকারের নেতৃত্ব দানের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি হলো সব সরকারের স্বজন পোষণের নিরাপদ প্রতিষ্ঠান; যোগ্যতা যেখানে কখনো বিচার্য নয়। ফলে জাতীয় স্বার্থ কোনো সরকারের আমলেই প্রাধান্য পায়নি। কারিকুলাম কমিটি গঠনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেও আমরা সেখানে পদাধিকারীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আবিষ্কার করব। ফলে, প্রকৃত শিক্ষাবিজ্ঞানী বা শিক্ষাবিদদের কোনো সুপারিশই সেখানে গ্রাহ্য হয় না। আমরা হতাশার সঙ্গে এটাও লক্ষ করব যে, শিক্ষকদের ওপর আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বিস্তার এখন অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর তাই আজগুবি সব ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সব বিষয়ে আমলাদের প্রাধান্য অন্য পেশাজীবী বিশেষজ্ঞদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। আর সেই বিষবৃক্ষ প্রতিনিয়ত আমাদের স্বপ্নভঙ্গের প্রধান কারণে পরিণত হয়েছে।
এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে, এক কথায় যা অবিশ্বাস্য। যেমন, আজ মঙ্গলবার যশোর বোর্ডের আইসিটি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। কারণ, প্রশ্নপত্রে মারাত্মক ভুল ধরা পড়েছে। আইসিটি প্রশ্নপত্রের প্রায় অর্ধেক প্রশ্ন এসেছে অন্য একটি বিষয় ক্যারিয়ার শিক্ষা থেকে, যেটির পরীক্ষা আগামীকাল হওয়ার কথা। যশোর বোর্ড অবশ্য পরীক্ষার্থী, অভিভাবক সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। তবে চেয়ারম্যান মহোদয়ের অসহায়ত্ব প্রকাশিত হয়েছে অন্য একটি বক্তব্যে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, আগামীকাল নির্ধারিত ক্যারিয়ার শিক্ষা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কি না। তিনি বলেছেন, সেটা বলবে মন্ত্রণালয়।

আমাদের কপাল! শিক্ষা মন্ত্রণালয় এভাবেই কয়েক দশক ধরে শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওপর অন্যায্য, অপ্রত্যাশিত খবরদারি করে চলেছে। পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল তৈরি, ফল প্রকাশ একান্তই শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব; অন্তত ১৯৬১ সালের যে অরডিন্যান্স বলে শিক্ষা বোর্ডগুলো স্থাপিত, সে অরডিন্যান্সে তা-ই বলা আছে। কিন্তু আইনে থাকলে কী হবে? গত কয়েক দশকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা বোর্ডগুলোর প্রায় সব স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। তাই কোন বোর্ডে কতজন পরীক্ষার্থী অংশ নেবে, এই অতি সাধারণ তথ্যটি প্রকাশ করার কোনো অধিকার এখন কোনো শিক্ষা বোর্ডের নেই, সেটা বলার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, নিদেন পক্ষে সচিব মহোদয় আছেন না!

স্বাধীনতা মানুষকে স্বশাসনের অধিকার প্রদান করে। আর সব ধরনের স্বশাসনই কর্তব্যবোধ দ্বারা সীমিত। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কেবল কেন্দ্রই স্বাধীন, অপরাপর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর। স্বাধীনতা যেখানে স্থানীয় সরকারের বিকাশ ঘটায়, এ দুর্ভাগা দেশে তা আরও কেন্দ্রীভূত করে।

আমরা কেউ জানি না আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কোন পথের যাত্রী। কিন্তু এটা জানি, উন্নতির স্বর্ণশিখরে ওঠার মহাসোপান আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। এই যুব-আধিক্য (পপুলেশন ডিভিডেন্ট) সময়ে যদি আমরা উন্নতির জন্য যোগ্য, দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, তার পরিণাম হবে মারাত্মক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, দেশে বহু কিসিমের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, সে ব্যাপারে আমরা সরকারের কোনো উদ্যোগ আয়োজন দেখতে পাচ্ছি না।

নতুন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। তিনি যেন মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সামলান। পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধের উদ্যোগ নেন; এবং একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan7@gmail.com

আরও পড়ুন
যশোর বোর্ডে এসএসসির আইসিটি পরীক্ষা বাতিল