Thank you for trying Sticky AMP!!

পাকিয়াব একটি অনন্য উদ্যোগ

শালগাছগুলো একেবারেই নবীন

কোনো বিশেষ একটি বনকে সংরক্ষিত বা অভয়ারণ্য ঘোষণা করে সাধারণত বন বিভাগ। ব্যতিক্রম ঘটালেন সিমিন হোসেন। গাজীপুর–৪ আসনের এই সাংসদ কাপাসিয়া উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নের পাকিয়াব গ্রামের ৮০ একর শালবনকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছেন, নাম দিয়েছেন ‘কুহু’। এ উপলক্ষে সেখানে তিনি গাছের চারাও লাগিয়েছেন।

প্রকৃতি সংরক্ষণে তাঁর এই পদক্ষেপ অন্যদের জন্য অনুসরণীয়। প্রতিনিয়ত উজাড়, দখল ও দূষণের কবলে বনের পরিধি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। এমন ক্রান্তিকালে একজন সাংসদের এই উদ্যোগ আমাদের নতুনভাবে উজ্জীবিত করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমত আরা বলেন, দেশি পাখি এই বনে যেন নির্বিগ্নে বাস করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে। পশুপাখির খাবার জোগাবে, এমন গাছপালা লাগানো হবে। খুব ভালো কথা। বনাঞ্চলগুলো আবাসিক পাখি ও প্রাণিবান্ধব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তাদের অন্য কিছু পরিকল্পনা আমাদের শংকিত করে তুলেছে। কারণ ওই কর্মকর্তাই বলেছেন বনে কয়েকটি পুকুর খুঁড়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মাছ চাষ করা হবে। বনভূমির একটি অংশ পর্যটকদের ঘোরাফেরার উপযোগী করে তৈরি করা হবে। কিন্তু মাছ চাষ করে বনের ইকোসিস্টেম ধ্বংস করা, বনের প্রাকৃতিক পরিবেশে বিঘ্ন ঘটিয়ে পর্যটন কেন্দ্র বানানো যৌক্তিক কাজ হতে পারে না। এই ধরনের কর্মকাণ্ড মূল উদ্যোগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আশা করি বন বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসন এই কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকবে।

বনের প্রাণীদের খাদ্যশৃঙ্খল, আবাস ও প্রজননসহ সব প্রাকৃতিক সুরক্ষার নিরাপদ সংস্থানকেই সামগ্রিকভাবে অভয়ারণ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রস্তাবিত এই অভয়ারণ্যে আবাসিক প্রাণীদের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে কি? সেখানে কত প্রকারের কী পরিমাণ প্রাণী ও পাখির বাস, বর্তমানে সেগুলো কী অবস্থায় আছে, প্রাণীগুলোর খাদ্য সংস্থান কীভাবে হবে, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা না হলে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। পাশাপাশি পাখি ও প্রাণীদের নির্বিঘ্নে বসবাস এবং বন সংরক্ষণে নিবিড় পাহারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এই বনের হারিয়ে যাওয়া উদ্ভিদ, যা থেকে পাখি ও প্রাণীদের খাবার সংস্থান হতো, দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে।

গাজীপুরের শাল বনাঞ্চলের অধিকাংশই নানাভাবে দেখা হয়েছে। প্রতিটি ঋতুবদলের সঙ্গে বনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তা অনুভব করতে শালবনে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু পাকিয়াবের এই বনে আগে কখনো যাওয়া হয়নি। বনটিকে অভয়ারণ্য ঘোষণার পর সেখানে যাওয়ার ইচ্ছটা জোরালো হল। আকাঙ্ক্ষা আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিলেন বনচারী ও বৃক্ষভক্ত যায়েদ আমীন। শহরে থেকেও মনের ভেতর যিনি একটি বন পুষে রাখেন। দুজনে একটা দিন ঠিক করে সেখানে চলে গেলাম। বনে ঢোকার আগে মনে হলো এদিকটায় বসতি কিছুটা হালকা। বনের জন্য এটি আশীর্বাদ। তবে বন বলতে যা বোঝায় তার পরিধি খুব বেশি না। আবার সতর্ক না হলে পথ হারানোর শঙ্কা। আছে বানরের কয়েকটি দল। তেমন একটি দলের সঙ্গে দেখাও হলো। কিছু রূপসী ফুলেরও দেখা পেলাম। ওদের বিরক্ত না করে বনটি ঘুরে দেখলাম। কোথাও কোথাও বনতল বেশ ঘনবদ্ধ। ভরদুপুরেও সূর্যের আলো নেই।

তবে হতাশার চিত্রও আছে। সর্বত্র বৃক্ষ নিধনের চিহ্ন। একটি ময়লার ভাগাড়ও চোখে পড়ল। অবশিষ্ট শালগাছগুলো একেবারেই নবীন। তৃতীয় প্রজন্মের গাছও চোখে পড়েনি। এটা অবশ্য দেশের সব বনেরই সাধারণ চিত্র। আমাদের মানসিকতাই এমন যে বন মানেই লুটপাটের মাল। ইচ্ছেমতো ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অধিকার। ময়লার ভাগাড় বানানো যায়। নিজের মতো করে ব্যবহার করা যায়। দখল করা যায়, দখল করা স্থানে কারখানা তৈরি করে ইচ্ছেমতো বর্জ্য ফেলে পরিবেশদূষণও করা যায়।

দিন শেষে শালবন আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ করল অনেক বিস্ময়। সমৃদ্ধ হলো আমাদের বৃক্ষজ্ঞান। অনেক বৈরী পরিস্থিতিতেও দিব্যি টিকে আছে কুমারী লতা, দু–একটি ছাতিম, ম্যাকারাঙ্গা, বনবরই, পিচণ্ডি, গুলঞ্চ লতা, শিকোরি, মনকাঁটা, কানাইডিঙ্গা, বেত, বহেড়া, বনওকরা, বাজনা, বনটগর ও কিছু বিচিত্র ফার্ন। সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি কারিপাতার গাছ দেখে। ভেবেছিলাম কারিপাতা আমাদের দেশে পালিত উদ্ভিদ। কিন্তু এই বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অনেকগুলো গাছ দেখে নিশ্চিত হলাম গাছটি আমাদেরই স্বদেশী। ঘুরতে ঘুরতে বনের ভেতর একটি জলাধারের পাশে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফার্নও পেলাম। তবে কৃত্রিম এই জলাশয়টি যে একটি মৎস্যখামার, বুঝতে সময় লাগল না। কিন্তু বনের ভেতর মাছ চাষ কেন, মাথায় ঢুকল না। নানা পদ্ধতিতে শালবন হজম করার এটাও একটা মাধ্যম!

না, এসব নেতিবাচক কথা আজ আর ভাবতে চাই না। শুরু করেছিলাম একটি ইতিবাচক গল্প দিয়ে। সেই গল্পটা ধীরে ধীরে ডানা মেলুক আকাশে। সবার ভেতর বেঁচে থাকুক অরণ্য-প্রাণের সহস্র সতেজ ধারা।

মোকারম হোসেন প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব