Thank you for trying Sticky AMP!!

পিলো-টক

আবুল হায়াত।

বস্তুটির উদ্ভাবন ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ অব্দে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়। কথায় আছে না, প্রয়োজনই মানুষকে উদ্ভাবনে অনুপ্রাণিত করে। এ ক্ষেত্রেও ঘটেছিল তা-ই। মানুষ নিজের স্বস্তির জন্যই বস্তুটি উদ্ভাবন করেছিল। চার কোনা আকারের বস্তুটিতে একটি খাঁজ রাখা হয়েছিল ব্যবহারের সুবিধার জন্য।

প্রথম উদ্ভাবনে এটি ছিল নীরেট শক্ত পাথর। কত বড় হতে পারে সেটি? প্রয়োজন বলে, বড় করে এক থেকে সোয়া ঘনফুট। তাহলে তার ওজন বড়জোর ছিল ১০০ থেকে ১৫০ পাউন্ড বা ৪০ থেকে ৭০ কেজির মতো। শুধু সমাজের উচ্চ অবস্থানের ব্যক্তিরাই বস্তুটি ব্যবহার করতেন।

সময় এগিয়েছে। এগিয়েছে স্বস্তির চাহিদা। সুতরাং বস্তু আকার ও ওজনেও এসেছে পরিবর্তন। এদিকে এগিয়ে গেল চীনারা। তারা ওই জিনিসটাই তৈরি করল। কিন্তু কাঠের। ওজন কমে গেল, ব্যবহারকারীর বাড়ল স্বস্তি। আনা-নেওয়া, ওঠানো-নামানো খুব সহজ হয়ে এল। তারপর তারা বানাল চিনামাটির, বানাল ব্রোঞ্জ দিয়ে। বিভিন্ন আকার দিল বস্তুটির। সবই করা হলো ব্যবহারকারীর স্বস্তি ও আরামের জন্য। এগুলোও ব্যবহার করতেন সমাজের মাথারা। গর্ভবতী নারীদেরও ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হতো।

রোমানরা এগিয়ে গেল আরও। কালচক্রে যেহেতু মানুষের বুদ্ধিরও বিস্তার ঘটেছে, সেহেতু নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য বস্তুটির বিবর্তনে তারা পিছিয়ে থাকেনি। তারা এই বস্তুটিই বানাল খড়বিচালি দিয়ে, তুষ দিয়ে, বালি দিয়ে। এগুলো থলেতে ভরে এক থেকে সোয়া ঘনফুট ঘনত্বের বস্তুটি তারা অধিকার করে ফেলল নতুন আকারে।

এরপর? অনেক সময় গড়িয়েছে। থলেটা ঠিকই আছে, কিন্তু এর ভেতরে এখন থাকে তুলো, না হয় পাখির পালক, না হয় স্পঞ্জজাতীয় পদার্থ। এর ওপর মাথা রেখে যত স্বস্তি, শান্তি, আরাম। লাখ টাকার স্বপ্নও দেখে এতে মাথা রেখে; এর সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলে জড়িয়ে ধরে চোখের জল, নাকের জল এক করে ফেলে।

জি। এটা বালিশ। ইংরেজিতে বলে পিলো (Pillow)। এই পিলো শব্দ এসেছে মধ্যযুগের ইংরেজি PILWE বা পুরোনো ইংরেজি শব্দ PYLE থেকে। নামটি জনপ্রিয় হয়েছে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। কিছুদিনের মধ্যে Pillow Talk-ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার মানে ‘বিছানায় শুয়ে ঘনিষ্ঠ কথোপকথন’।

মাফ করবেন, আমি যদিও কোনো পিলো-টক করতে চাই না, তবু পিলো নিয়ে কিছু টক তো পিলো-টকই হয়ে যায় আরকি! বাংলাদেশে এর আগে কখনো পিলো বা বালিশ জিনিসটা এত আলোচনার বস্তু হয়নি। কিন্তু আজ এর কপাল খুলে গেছে। কারণ, বড়জোর এক কেজি ওজনের একটি বালিশ মাটি থেকে দশ-বিশতলা পর্যন্ত ওঠাতে যখন প্রায় দশ কথার প্রয়োজন হয়, তখন এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।

এখনকার দিনে বালিশ শুধু আরামের বস্তুই নয়, প্রয়োজনীয়ও। বালিশ থেরাপিতে বহু রোগী নানা রোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। এর ব্যবহারেও বৈচিত্র্য এসেছে। ঘরের সৌন্দর্যবর্ধনে এর (কুশন) ব্যবহার এখন যত্রতত্র। মানুষও এখন শুধু মাথায় ব্যবহার করে না; পায়ে, বুকে, ঘাড়ে, কাঁধে, পিঠেও ব্যবহার করে এই বালিশ। বালিশ নিয়ে মারপিটও জমে ভালোই।

কিন্তু বালিশ কি খাওয়ার বস্তু? হ্যাঁ, বালিশ খাওয়াও হয়। নেত্রকোনায় গিয়েছিলাম ১৯৮৯ সালে। একটি সংবর্ধনায়। বহুব্রীহি ধারাবাহিকের সোবহান সাহেব তখন খুবই জনপ্রিয়। সেই চরিত্রাভিনেতা হিসেবে আমার সংবর্ধনা।

সংবর্ধনা শেষে গভীর রাত পর্যন্ত চলছিল জমজমাট আড্ডা। বাইরে প্রবল বর্ষণ। এক ভদ্রলোক ভিজতে ভিজতে এসে ঢুকলেন। হাতে একটি প্যাকেট।

‘স্যার, এটা না খেলে তো নেত্রকোনায় আসাটা ষোলো আনাই বৃথা।’

‘কী ভাই?’ অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করি।

‘বালিশ।’

প্যাকেট খুলে দেখা গেল, বালিশের মতো বিশালাকার এক মিষ্টি। ওজন আধা কেজি তো হবেই। চমচমের মতো। ওপরে খিরসার আবরণ।

‘খান স্যার। আমার খুব শখ, আপনি এটা খাবেন, আমি দেখব। আপনি আমার খুবই প্রিয় শিল্পী, স্যার।’ ভদ্রলোক অনুরোধ করলেন।

কী আর করা, ভক্তের অনুরোধ রক্ষা করতেই হয়। সুতরাং বালিশ ভক্ষণে সম্মত হলাম। তার আগে গদগদ কণ্ঠে বললাম, ‘আপনার ভালোবাসায় আমি আবেগাপ্লুত। নিশ্চয়ই খাব, তবে এত বড় বালিশ তো একা খাওয়া সম্ভব নয়। আসুন, সবাই হাত লাগাই।’

অতঃপর উপস্থিত ২০-২২ জন মিলে হাত লাগালাম বালিশটি ভক্ষণ করতে।

আমি নিশ্চিত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে এত ভারী গুরুত্বপূর্ণ বালিশগুলোও নিশ্চয় একা হাতে সাবাড় করা সম্ভব হয়নি। লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে অসংখ্য হাত নিশ্চয় রয়েছে।

এগুলোর পরিচয় জানা প্রয়োজন, তাই না?

নইলে ভবিষ্যতে তো আরও ভারী ভারী বস্তু ওঠানো-নামানোর প্রয়োজন হবে। সামলাব কী করে আমরা?

আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব