Thank you for trying Sticky AMP!!

পুঁজি পাচারকারীরা জাতির দুশমন

যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) বাংলাদেশকে বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতি হিসেবে ঘোষণা করে পূর্বাভাস দিয়েছে যে আগামী ১৫ বছর বাংলাদেশ যদি সাত শতাংশ বা তার বেশি বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জন ধরে রাখতে পারে, তাহলে ২০৩৩ সালে বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে।

এই ঘোষণার মধ্যে আমাদের গর্ব করার বিষয় হলো বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। সিইবিআরের ঘোষিত বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং মোতাবেক বিশ্বে ভারতের অর্থনীতির অবস্থান পঞ্চম, আর পাকিস্তানের ৪৪তম। পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেহেতু বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে প্রায় আড়াই কোটি বেশি হয়ে গেছে, তাই মাথাপিছু জিডিপির বিচারেও এখন বাংলাদেশের পেছনে পড়ে গেছে পাকিস্তান। মানব উন্নয়ন সূচকের মাপকাঠিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে টপকে গেছে প্রায় এক দশক আগে, বাকি ছিল মাথাপিছু জিডিপি।

১৯৬৮-৬৯ অর্থবছরে তদানীন্তন পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৯৯ দশমিক ৫৮ ডলার, আর পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ৪০ দশমিক ৩৪ ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মোতাবেক বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি প্রাক্কলিত হয়েছে ১ হাজার ৭৫১ ডলার। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৬০২ ডলার, আর পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৫৪১ ডলার (উইকিপিডিয়া)। আইএমএফের বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং মোতাবেক ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পাকিস্তানকে মাথাপিছু নমিন্যাল জিডিপির দিক থেকেও টপকে গেল।

অতএব, উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় পাকিস্তান ভবিষ্যতে আর বাংলাদেশের নাগাল পাবে না, যদি আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান ধারা নিজেরাই বরবাদ না করি। এ দেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াতের মতো যেসব দল বা জোট এখনো পাকিস্তানের প্রেতাত্মা বহন করে চলেছে, তারা যাতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংঘাতমূলক রাজনীতির পুরোনো ধারা ফিরিয়ে এনে উন্নয়নের এই সফল যাত্রা থামিয়ে দিতে না পারে, সে জন্য ÿক্ষমতাসীন ও বিরোধী সব মহলকে সার্বক্ষণিক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের আগে তদানীন্তন বাংলা ছিল সারা ভারতবর্ষে সবচেয়ে সমৃদ্ধ কৃষি অর্থনীতি এবং কুটির শিল্পজাত পণ্য রপ্তানির বিশ্বখ্যাত অঞ্চল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুঁজি লুণ্ঠন, পুঁজি পাচার, লুটেরা শাসন-শোষণের শিকার হয়ে পরবর্তী ১০০ বছরে ওই সমৃদ্ধ অর্থনীতি অবিশ্বাস্য বর্ণবাদের অসহায় শিকারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ঐতিহাসিক ব্রুকস অ্যাডামস জানাচ্ছেন, ১৭৫৭ সালের পর বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে কাঠের জাহাজে পুঁজি পাচার এত বিপুলভাবে বেড়ে গিয়েছিল যে ওই জাহাজগুলোকে লন্ডন বন্দরে মাল খালাস করার জন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হতো। এই লুণ্ঠনপর্বকে ইতিহাসবিদেরা ‘দ্য বেঙ্গল লুট’ নামে অভিহিত করেন।

আজকের কলামে আমি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমাদেরই দেশের পুঁজি পাচারকারী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি, যারা প্রতিবছর গড়ে ৯০০ কোটি ডলার ( প্রায় ৭৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) বা তারও বেশি পুঁজি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে বলে নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) গবেষণায় উদ্ঘাটিত হয়েছে। জিএফআইয়ের এই হিসাব ২০১৩ সালের, এর আগে ২০১১ সালে আইএলও জানিয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৫০০ কোটি ডলার পুঁজি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তখনই আমাদের নীতিপ্রণেতাদের আমরা পুঁজি পাচার প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়েছিলাম, কিন্তু ওই আহ্বান যে বিফলে গেছে সেটা বোঝা গেল জিএফআইয়ের ৯০০ কোটি ডলারের সর্বশেষ হিসাবটা প্রকাশিত হওয়ায়। ছয় বছর পর ২০১৯ সালে এসে পুঁজি পাচারের পরিমাণ যে আরও বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের একটা অংশ পুঁজি-পাচারের প্রধান কুশীলব হিসেবে বহুল পরিচিত হলেও বর্তমানে দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক-সিভিল আমলা-সামরিক অফিসার-প্রকৌশলী-পেশাজীবীরা এখন পুঁজি-পাচারকারীর ভূমিকা পালনে কামেলিয়ত হাসিল করেছেন। সপরিবার বিদেশে হিজরত করে কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে পরবর্তী সময়ে দিন গুজরানের খায়েশে এই নব্য পাচারকারীরা এখন অহর্নিশ পুঁজি পাচারে মেতে উঠেছেন। বৈদেশিক বাণিজ্যে আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং কিংবা ফেইক ইনভয়েসিং পুঁজি পাচারের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি, আর রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় যথাযোগ্যভাবে জমা না দিয়ে বিদেশে রেখে দেওয়া পুঁজি পাচারের সবচেয়ে ‘পপুলার মেথড’।

কিন্তু এই পুরোনো পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি এখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহুল ব্যবহৃত হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানোর অভ্যাস পুঁজি পাচারকারীদের একটি সহজ বিকল্প উপহার দিয়েছে পলাতক পুঁজির পলায়নকে একেবারে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন ও সুলভ করে দেওয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক দেশে ২০১৮ সালে ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ডেড/ডকুমেন্টেড চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে, যে পরিমাণটা গত বছরের তুলনায় ভালো প্রবৃদ্ধির পরিচায়ক বলা হচ্ছে। কিন্তু হুন্ডি পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ যেহেতু বিদেশেই থেকে যায়, তাই ঠিক কত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিবছর হুন্ডি চক্রে প্রবেশ করছে তার হদিস পাওয়া প্রায় অসম্ভব বলা চলে। কিন্তু এই ‘হুন্ডি ডলারের’ সবচেয়ে বড় অংশের সমপরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স প্রেরকের পরিবারের সদস্যরা ও আত্মীয়স্বজন যেহেতু পেয়ে যাচ্ছেন, তাই এই অর্থ প্রবাসীদের পরিবার ও স্বজনদের ভোগ এবং বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। ফরমাল চ্যানেল বা ইনফরমাল চ্যানেল—যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক না কেন, তার অর্থনৈতিক সুফল পুরো অর্থনীতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এত বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সত্ত্বেও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না, তার পেছনেও রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানত প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এক অর্থে এই বিপুল অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ যে এখনো বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যর্থ, অর্থনীতিতে তার তেমন একটা আসর পড়ছে না এই রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের চমকপ্রদ উল্লম্ফন ঘটাচ্ছে প্রবাসীদের ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স, এটা এখন সারা বিশ্বের সপ্রশংস মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে।

কিন্তু যে হুন্ডি ডলার বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলো হুন্ডি চক্রগুলোর কাছ থেকে কারা কিনছে? ওখানেই পুঁজি-পাচারের সঙ্গে এই ব্যাপারটা জড়িয়ে যাচ্ছে। আমার গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছি যে দেশে দুর্নীতিজাত কালোটাকার মালিকেরা এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ‘কালচার’ যাঁরা সৃষ্টি করেছেন, সেই ব্যবসায়ীরা এই হুন্ডি ডলারের সবচেয়ে বড় খদ্দের। মার্জিনখোর রাজনীতিক বলুন, দুর্নীতিবাজ আমলা-সামরিক অফিসার-প্রকৌশলী বলুন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বলুন, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুন—হুন্ডি ডলারের সহায়তায় বিদেশে পুঁজি পাচারে মশগুল হয়ে রয়েছে বাংলাদেশের অনেক উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার। আর এভাবেই ক্রমে গড়ে উঠছে টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম কেনার রমরমা কালচার।

খেলাপি ঋণের ওপর আমার গবেষণায় উঠে এসেছে যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সিংহভাগই আদতে ফেরত পাওয়া যাবে না। কারণ, এই ঋণের অর্থ আসলে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ পাচারকারী এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে পুঁজি পাচারকারীদের সে জন্যই আমি ‘ঘৃণ্য জাতীয় দুশমন’ আখ্যায়িত করছি। দেশ থেকে পাচার হওয়া ৯০০ কোটি ডলার যদি প্রতিবছর দেশে নানা উৎপাদনশীল কার্যক্রমে বিনিয়োজিত হতো, তাহলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নয়-দশ শতাংশে উন্নীত হয়ে যেত কি না, তা সবাইকে ভেবে দেখতে বলি।

ড. মইনুল ইসলাম: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক