Thank you for trying Sticky AMP!!

পুতিনের চালে কি আসলেই ভুল হচ্ছে

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

পুতিন ভেবেছিলেন রুশভাষী ইউক্রেনীয়রা তাঁর সেনাদের স্বাগত জানাবেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি দ্রুত ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। তিনি করতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি ন্যাটোতে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন। তিনি উল্টো তাতে ঐক্য তৈরি করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, তিনি তাঁর অর্থনীতিকে সুরক্ষিত-প্রমাণ করতে পেরেছেন। তিনি আসলে তা ধ্বংস করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন চীনারা তাঁকে সাহায্য করবে। কিন্তু বাজিতে নামিয়ে তারা সরে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর আধুনিক সামরিক বাহিনী ইউক্রেনীয় বাহিনীকে মাংসের কিমা বানানোর মতো কুটি কুটি করবে। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা তাঁর সেনাদের অন্তত সম্মুখযুদ্ধে কিমা বানাচ্ছে।

পুতিনের ভুল হিসাব–নিকাশ তাঁর কৌশলগত বিচারবুদ্ধি এবং মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। প্রশ্ন উঠছে, কেউ যদি তাঁকে নেপথ্য থেকে পরামর্শ দিয়ে থাকে, তাহলে তিনি কে? পুতিন কি বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন? তিনি কি শারীরিকভাবে অসুস্থ? মানসিকভাবে? সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস পুতিনের বিষয়ে সতর্ক করেছেন, ‘তিনি তাঁর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থায় নেই। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে।’

ইউক্রেনের মারিউপোল এবং খারকিভ—এ দুটি রুশভাষী শহরকে ঘিরে রেখে (পুতিনের ভাষায় তাদের ইউক্রেনীয় নিপীড়ন থেকে ‘মুক্ত’ করা হয়েছে) যা করা হয়েছে তা নাৎসিরা ওয়ারশকে যা করেছিল এবং পুতিন নিজে গ্রোজনিকে যা করেছিলেন তার সঙ্গে মিল আছে।

বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক পুতিনকে কোণঠাসা ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি এখন আরও বিপজ্জনক। কারণ চলমান ঘটনাপ্রবাহ এখন আর তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই জো বাইডেনের কণ্ঠে প্রায় সর্বজনীন তিরস্কার শোনা গেছে, ‘ঈশ্বরের নামে বলছি, এই লোক কিছুতেই ক্ষমতায় থাকতে পারেন না।’

এ যুদ্ধ ইতিমধ্যে রাশিয়ার অভ্যন্তরে পুতিনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের মধ্যে যাঁরা আলেক্সেই নাভালনির মতো ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এ যুদ্ধের ফলে সেই ভিন্নমতাবলম্বীরা এখন ভয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যাবেন। সংবাদমাধ্যমের যতটুকুওবা স্বাধীনতা এ যুদ্ধের অজুহাতে তা–ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে পুতিনেরই লাভ হয়েছে।

পুতিনসংক্রান্ত এই সব বহুল প্রচলিত কথা সবার কাছে প্রশংসা পাচ্ছে। বিদ্যমান রাজনীতি ও সমরনীতির প্রচলিত হিসাব-নিকাশ এ উপসংহারের দিকে ঝুঁকছে যে পুতিন যদি শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের আরও কিছু অঞ্চল, ইউক্রেনের জোটনিরপেক্ষ থাকার অঙ্গীকার এবং মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কিছু অংশের প্রত্যাহার পান, তাহলে সেটি তাঁর জন্য মুখ রক্ষার বিষয় হতে পারে। এগুলো পেলেই তিনি মানসম্মানের সঙ্গে সেনা গুটিয়ে আনতে পারেন।

কিন্তু প্রচলিত এ হিসাব–নিকাশ যদি ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে হলে কী হবে? যদি শেষ পর্যন্ত দেখা যায় পুতিন তাঁর হাতের তালুতে পশ্চিমাদেরই নাচাচ্ছেন, তখন কী হবে?

১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝিতে প্রথম চেচেন যুদ্ধের সময় রাশিয়া যখন গ্রোজনি অবরোধ করে, তখন সেখানে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেছিলেন দ্য টাইমস–এর সাংবাদিক কার্লোটা গ্যাল। তিনি তাঁর সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এ ধরনের একটি সম্ভাবনার কথা বলেছেন।

চেচেন যুদ্ধের প্রথম ধাপে উদ্দীপ্ত চেচেন যোদ্ধারা মস্কোকে হতভম্ব করে দিয়ে একটি রাশিয়ান সাঁজোয়া ব্রিগেডকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। পরে রাশিয়ানরা আবার সংগঠিত হয়েছিল এবং দূর থেকে কামান এবং বিমান শক্তি ব্যবহার করে তারা গ্রোজনিকে নিশ্চিহ্ন করেছিল।

মনে হচ্ছে, রাশিয়া আজ সেই একই ছকে খেলতে যাচ্ছে। পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকেরা যখন যুক্তি দেন, পুতিন ইউক্রেনে সামরিকভাবে জিততে পারবেন না, তখন তাঁদের কথার প্রকৃত অর্থ দাঁড়ায় পুতিন স্বচ্ছ যুদ্ধে জিততে পারবেন না। কিন্তু তাঁরা এটি মাথায় রাখেন না, পুতিন কবে বা কোন কালে স্বচ্ছতার সঙ্গে খেলেছেন?

কার্লোটা গ্যাল বলছেন, ‘পুতিনের ছক-বইয়ের একটি সম্পূর্ণ পরবর্তী ধাপ রয়েছে, যা চেচেনদের কাছে সুপরিচিত’। তিনি বলছেন, ‘যেহেতু রাশিয়ান সেনারা চেচনিয়ার মাটিতে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে, তারা প্রতিপক্ষের লোকদের গ্রেপ্তার করে এবং নিজেদের পক্ষের লোকদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে স্থানীয় সহযোগীদের ক্ষমতায়িত করবে এবং ভিন্নমতকে আগের চেয়েও বেশি চূর্ণ–বিচূর্ণ করবে।’

ধরা যাক, পুতিন কখনোই সমস্ত ইউক্রেনকে জয় করতে চাননি। ধরা যাক, শুরু থেকেই তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের জ্বালানিসমৃদ্ধ এলাকা, যেখানে ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম পরিচিত মজুত রয়েছে (নরওয়ের পরে)।

Also Read: পুতিনের বিচারের দাবি এখন বৈশ্বিক

রাশিয়ার পূর্বতন দখলকৃত ক্রিমিয়া (যার বিশাল উপকূলজুড়ে জ্বালানিক্ষেত্র রয়েছে), পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক (যেখানে একটি বিশাল শেল-গ্যাস ক্ষেত্রের অংশ রয়েছে) এবং সেই সঙ্গে উপকূল এলাকার নিয়ন্ত্রণকে একত্র করে দেখুন। এতেই পুতিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ থেকেই বোঝা যায়, তিনি রাশিয়ার জ্বালানি আধিপত্য সুরক্ষিত করার চেয়ে রুশ ভাষাভাষী বিশ্বকে পুনরায় একত্র করতে কম আগ্রহী।

যদি এ বিশ্লেষণ ঠিক হয়, তাহলে পুতিনকে তাঁর সমালোচকেরা যেভাবে ভুল হিসাব করা লোক বলে যেমনটা ভাবছেন, আসলে তিনি যে তেমনটি নন, সেটাই প্রমাণিত হবে।

Also Read: যুদ্ধ থামাতে পুতিনকে যে চাপ দিতে পারেন সি চিন পিং

পুতিন এখন যে কৌশল নিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে, তিনি বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু করছেন। বেসামরিক লোকদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে চান, যাতে পুতিন সব সময় যে দাবি করে আসছে তা যাতে জেলেনস্কি মানতে বাধ্য হন। সেই প্রধান দুই দাবি হলো: ইউক্রেনকে আঞ্চলিক ছাড় দিতে হবে এবং দেশটিকে জোটনিরপেক্ষ থাকতে হবে।

অন্যদিকে আমরা যেভাবে নিজেদের বোঝাচ্ছি যে পুতিন একজন মানসিকভাবে অস্থির লোক এবং তিনি যে কোনো সময় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বসতে পারেন। এতে পশ্চিমারাও পুতিনকে না রাগিয়ে উত্তেজনা কমাতে নমনীয় হতে বাধ্য হতে পারে।

এ যুদ্ধ ইতিমধ্যে রাশিয়ার অভ্যন্তরে পুতিনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের মধ্যে যাঁরা আলেক্সেই নাভালনির মতো ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এ যুদ্ধের ফলে সেই ভিন্নমতাবলম্বীরা এখন ভয়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যাবেন। সংবাদমাধ্যমের যতটুকুওবা স্বাধীনতা এ যুদ্ধের অজুহাতে তা–ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে রাজনৈতিকভাবে পুতিনেরই লাভ হয়েছে।

পুতিনের কর্মক্ষমতার এ বিকল্প বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে। তারপরও, এ বিশ্লেষণ মনে করিয়ে দেয়, যুদ্ধ-রাজনীতি-জীবনে আপনার প্রতিপক্ষকে পাগল বা বোকা না ভেবে একটি ধূর্ত শিয়াল হিসেবে ভাবাই বুদ্ধিমানের কাজ।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • ব্রেট স্টিফেনস দ্য টাইমস-এর একজন নিয়মিত কলামিস্ট। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা কলামের জন্য ২০১৩ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি এর আগে দ্য জেরুজালেম পোস্ট–এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন।