Thank you for trying Sticky AMP!!

পেঁয়াজের পরিসংখ্যানেই বিভ্রান্তি

পেঁয়াজের দাম এক মাসের মধ্যে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ১০০ টাকায় উঠে যাওয়ার পর হয়তো কেউই ভাবেনি যে এটি খুচরা বাজারে ২০০ টাকা ছাড়াবে। তাই অক্টোবরের শুরুতে ১০০ টাকা কেজি দরে যাঁরা পেঁয়াজ কিনেছেন, তাঁরা যখন মধ্য নভেম্বরে দাম ২০০ টাকা হতে দেখলেন, তখন একাধারে ক্ষুব্ধ-বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তাঁদের। আশার কথা যে বাজার তথা পুরো দেশ গরম করে তুলে পেঁয়াজের দর আবার কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে, আরও নেমে আসবে।

পেঁয়াজ নিয়ে ভোক্তা সাধারণের এই সংকটের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বা সিন্ডিকেটকে। এমনকি কথিত এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একাধিক বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেল-জরিমানাও করা হয়েছে। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকটা পাল্লা দিয়েই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে অপরাধী বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ দাম যখন বাড়তে শুরু করে এবং কেজিপ্রতি দর ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়, তখন দায়ী করা হয়েছে ভারতকে, সে দেশ থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার জন্য। আমাদের মোট পেঁয়াজ আমদানির ৯০ শতাংশই আসে ভারত থেকে।

ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়া ও তার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর অসাধু প্রবণতা আজকে পেঁয়াজের সংকট তৈরি করেছে বলে বেশির ভাগ মানুষ মনে করছেন। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে পেঁয়াজের সংকটের জন্য ব্যবসায়ীদের অসাধু যোগসাজশের বিষয়ে হুঁশিয়ারি জানিয়েছে। সরকারও পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখতে চাইছে।

অথচ বাজারে চাহিদার তুলনায় কোনো পণ্যের সরবরাহ কম হলে দাম বাড়বে, এটা স্বাভাবিক সূত্র। আর পণ্যটি যদি হয় নিয়মিত ব্যবহার বা ভোগের জন্য অপরিহার্য, তাহলে দাম বাড়লেও চাহিদা তেমন একটা কমবে না। আর চাহিদা না কমায় সরবরাহ ঘাটতির কারণে দামও চড়া থাকবে, এমনকি ক্রমেই বাড়তে থাকবে, যদি ক্রেতারা আরও দাম বাড়ার আশঙ্কায় বেশি করে কিনতে চেষ্টা করেন। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সম্প্রতি এ রকম প্রবণতাই দেখা গেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ আসা বন্ধ হওয়ায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দাম বাড়তে থাকায় ভোক্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে বাজারে ছুটেছেন। এর পাশাপাশি খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরাও পেঁয়াজের মজুত বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন এবং মজুত থেকে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেননি। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ার পথ তৈরি হয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে যে আয়বৈষম্য, তা-ও দাম বাড়াতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের হাতে প্রায় ২৮ শতাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকায় এ রকম বিত্তবান ক্রেতাদের জন্য ২০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কেনা মামুলি ব্যাপারই বটে।

লক্ষণীয় দিক হলো, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির পরিসংখ্যানে অস্পষ্টতা আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ (২০১৬) খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে, দেশে দৈনিক একজন মানুষ গড়ে ৩১ গ্রাম পেঁয়াজ খেয়ে থাকেন, যা ২০১০ সালে ছিল ২২ গ্রাম। মানে পাঁচ বছরে পেঁয়াজের মাথাপিছু ভোগ বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ। ২০০৫ থেকে ২০১০ সময়কালে এটি বেড়েছিল প্রায় ২০ শতাংশ হারে। দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৩ লাখ (শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৭, বিবিএস)। সে হিসাবে দেশে বছরে পেঁয়াজের ন্যূনতম চাহিদা হয় অন্তত ১৯ লাখ টন। গত মঙ্গলবার বাণিজ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে পেঁয়াজের দৈনিক চাহিদা ৬ হাজার টন। মানে বছরে চাহিদা প্রায় ২২ লাখ টন। তবে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের প্রাক্কলন অনুসারে, বার্ষিক চাহিদা অন্তত ২৪ লাখ টন।

পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদনের পরিসংখ্যানটা গোলমেলে। বিবিএসের হিসাবে, ২০১৮ সালে (২০১৭-১৮) দেশে ১৭ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের হিসাব অনুসারে, এই সময়ে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। মানে দুই সরকারি সংস্থার হিসাবে, পেঁয়াজের উৎপাদনে ৬ লাখ টন গরমিল, যা বিভ্রান্তি তৈরির জন্য যথেষ্ট। তবে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের অন্তত ২৫ শতাংশ নষ্ট হয় যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে। ফলে দেশীয় পেঁয়াজের সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ বাজারে আসে। এটি বিবেচনায় নিয়ে কৃষি
মন্ত্রণালয়ের হিসাব মানলে বছরে ৬ থেকে সাড়ে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা প্রয়োজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উপাত্ত অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৯ লাখ টন। বিবিএসের উৎপাদন হিসাব মানলে ও তা থেকে ২৫ শতাংশ বাদ দিলে আমদানি করতে হয় সাড়ে ৯ থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ।

সুতরাং পেঁয়াজের চাহিদা-জোগানের ভারসাম্য ঠিক রাখতে হলে প্রকৃত চাহিদা ও প্রকৃত উৎপাদন নির্ণয় করা জরুরি। আমদানির বিভিন্ন বিকল্প উৎসও খুঁজতে হবে। পর্যবেক্ষণ করতে হবে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন পরিস্থিতি। আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতাদেরও তদারকি করা প্রয়োজন। তবে সবগুলো কাজের জন্যই হালনাগাদ, বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান চাই। তথ্য-পরিসংখ্যানের ঘাটতি থাকলে বা সেগুলো নিবিড়ভাবে নিয়মিত বিশ্লেষণ করতে না পারলে সময়ে-অসময়ে বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। অসাধু কিছু ব্যবসায়ীও তার সুযোগ নেবে ও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে।

আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক
asjadulk@gmail.com