Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রতিরোধ্য বন্যায় অপ্রতিরোধ্য ক্ষতি

প্রথম আলো ফাইল ছবি

কয়েক দিন আগে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সিংরিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়ার জন্য। গাইবান্ধা থেকে যন্ত্রচালিত নৌকায় সিংরিয়া প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। গাইবান্ধা শহর থেকে একটু সামনে যেতেই সহযাত্রী গাইবান্ধা সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক দেখালেন ঘাঘট নদের বাঁধ ভেঙে কীভাবে পানি শহরে ঢুকে গিয়েছিল। যদি বাঁধটি না ভাঙত, তাহলে ওই এলাকায় বন্যা হতো না। আমরা যখন সিংরিয়া গ্রামে পৌঁছালাম, তখন বাঁধের রাস্তার ওপর কয়েক শ বানভাসি মানুষ অপেক্ষা করছিল। 

সিংরিয়া গ্রামে বকুল নামের এক যুবকের সঙ্গে বন্যা নিয়ে কথা বলি। তিনি জানালেন, সেখানেও বাঁধ না ভাঙলে বন্যা হতো না। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যে স্থানে বাঁধ ভেঙেছে, সেখানে গেলাম। সমস্ত বাঁধের ওপর অনেকগুলো পরিবার পলিথিনের ছাউনি দিয়ে চালা করেছে। কোনোটির নিচে মানুষ আর কোনোটির নিচে গবাদিপশু। ভেঙে যাওয়া অংশটিতে বাঁশের সাঁকো তৈরি করার কাজ চলছে। ভাঙা বাঁধের পাশেই মাঝবয়সী আবদুস সাত্তারের সঙ্গে কথা হলো। ওই ভাঙা স্থানের পাশেই তাঁর বাড়ি ছিল। তাঁর কাছে জানলাম, এবার এই স্থান ভাঙতে পারে তা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। বাঁধটি দুর্বল ছিল। 

সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বাঁধের রাস্তা ঠিক করতে চায় না। কোন স্থানে ভাঙতে পারে, কোথাও ইঁদুরের গর্ত আছে কি না, বন্যায় কোনো স্থান দুর্বল হয়েছে কি না, এসবের কোনো নজরদারি থাকে না। সরকার যদি সিংরিয়া গ্রামের বাঁধটি আগেই সংস্কার করত, তাহলে ফুলছড়িতে এই ভয়াবহ বন্যা আঘাত করত না। যমুনা নদীর তলদেশ এখন অনেকটাই পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমির চেয়ে উঁচু। ফলে বন্যা কমে যাওয়ার পরও অনেক দিন সিংরিয়া গ্রামের অনেক বাড়ি জলমগ্ন অবস্থায় ছিল। ওই গ্রামেরই একজন প্রবীণ ব্যক্তি আবদুল আজিজ। বয়স ১০৭ বছর। তিনি বলছিলেন, ‘এলা নদী বড় হইচে। গভীরতাও নাই। সেই জন্যে খালি বান হয়। কোনো দিন নদীটা খুঁড়বার দেখি নাই।’ 

এবার কুড়িগ্রামের সব কটি উপজেলায় বন্যা আঘাত হেনেছে। তার মধ্যে চিলমারী উপজেলার সম্পূর্ণটাই প্রায় পানির নিচে ডুবে ছিল। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় চিলমারীর যেসব এলাকায় পানি ওঠেনি, এ বছর সেসব এলাকাতেও পানি উঠেছিল। ২০ জুলাই প্রকাশিত প্রথম আলোর খবর সূত্রে জানলাম, ১৯৮৮ সালের চেয়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৩৫ শতাংশ কম। তারপরও বন্যা হয়েছে বেশি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, নদী প্রস্থে বাড়লেও গভীরতা কমে এসেছে অনেক। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ার চরের পাশে ধরলা নদীর বাঁধ ভেঙে পানি পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাড়িঘর ভেঙেছে। ডুবেও গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। কালুয়ার চরের পাশে বাঁধের যে অংশে ভেঙেছে, সে অংশে লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম দুই জেলার অংশই রয়েছে। দুই জেলার সমন্বয়হীনতার কারণেই নাকি ভাঙা অংশ মেরামত করা হচ্ছে না। বাঁধ ভেঙে বাড়ি নিশ্চিহ্ন হওয়া রমজান আলী বলছিলেন, ‘সামান্য একটু ভাঙা ছিল। ওইটুকু যদি সরকার ঠিক করি দেইল হয়, তা হইলে এবার এত বড় সর্বনাশ হইল না হয়।’ 

রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নে যেসব এলাকায় তিস্তা ভাঙছে, সেসব এলাকাও ভাঙার কারণ নদীর প্রতি অযত্ন। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় অল্প পানিতেই দুই পাড় ডুবে যায়। কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার মহাসড়কসংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম তিন বছর ধরে বন্যায় ডুবে যাচ্ছে। আগে এমনটা হতো না। এর নেপথ্য কারণ হচ্ছে ধরলার তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া। ২০১৭ সালে ভয়াবহ বন্যায় অকল্পনীয় পলি পড়েছে নদীতে। সেই ভরাট হওয়া নদীতে সামান্য পানি এলেই বন্যা প্রবল রূপ ধারণ করছে। বেসরকারি সংস্থা গণ–উন্নয়ন কেন্দ্রের (জিইউকে) প্রধান নির্বাহী আবদুস সালাম জানান, তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করলে নদীর কোন এলাকা ভাঙবে, তা আগাম বলা যায়। 

আশার কথা হচ্ছে, তিস্তা নদীর মূল প্রবাহকে একটি নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত করার জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুরের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের (পওর) নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, তিস্তার ১০০ কিলোমিটারের ওপর সমীক্ষা করেছে চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার। ওই প্রতিষ্ঠান নদীটিকে প্রস্থে এক কিলোমিটারের মধ্যে প্রবাহিত করার কাজের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করেছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নদীটিকে এক কিলোমিটার প্রস্থের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। তখন নদীর দুই পাড়ের হাজার হাজার হেক্টর খাসজমি ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠবে। নদীর নাব্যতা বাড়বে। বারো মাস নৌচলাচল উপযোগী হবে নদী। সারা বছর মাছ পাওয়া যাবে।

যে বন্যায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে, সেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। এ বন্যা যতখানি না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে ঢের বেশি মনুষ্য সৃষ্ট। সরকার যদি বন্যানিয়ন্ত্রণে নদীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ নজর দেয়, তাহলে সামান্য বর্ষায় বন্যা হবে না। 

আজ ১৭ আগস্ট, নদী অধিকার দিবস। এদিনের অঙ্গীকার হোক—নদী বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও। 

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

wadudtuhin@gmail.com