Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রবীণেরা তবে যাবেন কোথায়

বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে

৯ ফেব্রুয়ারি বিষের বোতল হাতে মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কাছারিতে হাজির হয়েছিলেন মুসা করিম। ৮০ পেরোনো এই মানুষটিকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে পুত্রবধূ ও নাতি। মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুরে তাঁর বাড়ি। গ্রামের লোকজনের কাছে বিচার দিয়েছিলেন, কেউ এগিয়ে আসেনি। জেলা প্রশাসক ব্যর্থ হলে সেখানেই আত্মহত্যা করবেন, এই ইরাদা নিয়ে হাতে করে তাই বিষের বোতল নিয়ে এসেছেন মুসা।

জেলা প্রশাসকের আমলে বিষয়টা আনা হলে প্রবীণের হাত থেকে বিষের বোতল তিনি নিয়ে নেন। তামাশা দেখতে আসা আমজনতাকে বলেন, ‘হতাশ একজন মানুষ অনন্যোপায় হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। তাঁকে নিবৃত্ত করা আমাদের দায়িত্ব। আর আপনারা কিছু না করে মজা দেখছেন?’ জেলা প্রশাসকের তিরস্কারে মানুষজন সরে যায়। তিনি প্রবীণকে আশ্বস্ত করেন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।

মুসা করিমের মতো সৌভাগ্য সবার হয় না। জেলা প্রশাসক দূরে থাক, গ্রামের মাতবর পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগই পান না স্বজনদের হাতে নিগ্রহের শিকার অধিকাংশ প্রবীণ। তাঁদের হাত থেকে বিষের শিশি-প্যাকেট কেড়ে নেওয়ার কেউ নেই।

মার্চে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যশোরের চৌগাছায় অবহেলা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিন প্রবীণ। তাঁরা হলেন উপজেলার সর্পরাজপুর গ্রামের মনোয়ারা (৫৫), বেলেমাঠের গোলাম মোস্তফা (৬০) এবং হাজরাখানার লোকমান হোসেন (৬০)। হাসপাতালে নিয়েও তঁাদের বাঁচানো যায়নি।

বাড়ছে গড় আয়ু, বাড়ছে অবহেলা

বিশ্বব্যাংক বলছে, ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর। ৫০ বছরে সেই আয়ু বেড়েছে ২৪ বছরের বেশি। একই সময়ে পৃথিবীব্যাপী মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে ১২ বছর। অন্য কথায়, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৈশ্বিক বৃদ্ধির দ্বিগুণ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি দিন বাঁচে মালদ্বীপের মানুষ। তাদের গড় আয়ু ৭৬ বছর। ১৯৭১ সালে ছিল ৪৪ বছর। অর্থাৎ ৫০ বছরে দেশটির গড় আয়ু বেড়েছে ৩২ বছর। এই অঞ্চলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় আয়ুর দেশ শ্রীলঙ্কা (৭৪ বছর)। ১৯৭১ সালে এই অঞ্চলে গড় আয়ুতে প্রথম ছিল শ্রীলঙ্কা (৬৪ বছর)। ’৭১-এর তুলনায় ভুটানের গড় আয়ু বেড়েছে ৩২ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) খবর দিয়েছে, বাংলাদেশে গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর।

আমাদের দেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব নিয়ে নানা কানকথা শোনা গেলেও বাংলাদেশে দিন দিন যে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, এটা বুঝতে চশমা লাগে না, রাস্তায় বের হলেই টের পাওয়া যায়। বলা হয়, গত ১০ বছরে প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষের বয়স ৬০ বছরের বেশি হলে দেশে প্রবীণের সংখ্যা হবে দেড় কোটির মতো। এই প্রবীণদের মধ্যে আবার সরকারি-বেসরকারি আছেন। নিয়মিত পেনশন পাওয়া সরকারি প্রবীণের সংখ্যা ৭ লাখের মতো। প্রবীণদের জন্য সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা নানা স্থাপনাতেও তাঁদের অগ্রাধিকার। বাকিরা সব অবহেলিত। তাঁদের নিয়মিত কোনো আয়–রোজগার নেই। আবার জমিজিরাত-ঘরবাড়ি থাকলে এক রকম কদর, না থাকলে অন্য রকম। নিজের জমিজিরাত সন্তানদের মধ্যে বিলিবণ্টন করেই তো বিপদে পড়েছেন মুসা করিম। অসন্তুষ্ট পক্ষ তাঁকে বাড়িছাড়া করে ছেড়েছে।

সন্তানসন্ততি যতই থাক, জোতজমি-নগদ টাকা, বাড়ি-ফ্ল্যাট নিজের কবজায় না রাখলেই বিপদ। গত জানুয়ারিতে কুমিল্লার বুড়িচং খাড়াতাইয়া গ্রামের প্রবীণ ও সাত সন্তানের জনক শামসুল হক সন্তানদের গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে কলেজের প্রভাষক বানিয়েছিলেন মাদারীপুরের কালকিনির অনিতা শিকদার। পারিবারিক অবহেলা আর জ্বালাযন্ত্রণা সইতে না পেরে ডিসেম্বরে তাঁকেও আত্মহত্যা করতে হলো।

ভাতা ও আইনের পাশাপাশি প্রবীণদের ভালো রাখার ব্যাপারে সমাজেরও একটা দায়িত্ব আছে। দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে নাতি-নাতনির চিরকালীন মধুর সম্পর্ককে আবারও গড়ে তুলতে হবে। ভাঙা পরিবারে যা আজ আর দেখা যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে

অবহেলা আর আত্মহত্যাই কি উন্নয়নের লক্ষণ

বৈষয়িক উন্নয়নের সঙ্গে বাড়ছে গড় আয়ু। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রবীণের সংখ্যা আর তাঁদের একাকিত্ব। যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট বছর কয়েক আগে শিল্পোন্নত ৩৫টি দেশের গড় আয়ু বৃদ্ধি নিয়ে চিত্তাকর্ষক একটা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে লেখক দেখিয়েছিলেন যেসব দেশ শিক্ষা-কাজ-অবসর পরিকল্পনা পুনর্গঠন করেছে, বাড়িয়েছে স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে বিনিয়োগ, সেগুলোর গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি।

২০৩৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের গড় আয়ু হবে ৯০ বছর। সেই কোরিয়া এখন প্রবীণদের ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে খাবি খাচ্ছে। ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরীয়দের মধ্যে মৃত্যুর চতুর্থ সর্বোচ্চ কারণ ছিল আত্মহত্যা। সে দেশের প্রবীণদের আত্মহত্যার একটি কারণ একাকিত্ব ও দারিদ্র্য। কোরিয়ার প্রায় অর্ধেক প্রবীণ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। পরিবারের আর্থিক বোঝা কমাতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তাঁরা। ছেলেমেয়েরাও মাতা-পিতার দেখভাল করাটাকে আর দায়িত্ব মনে করছে না।

ভারতে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটির কাছাকাছি, মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০১১ সালের আদমশুমারি বলছে, প্রায় দেড় কোটি প্রবীণ সম্পূর্ণ একা বাস করেন, যার তিন-চতুর্থাংশই নারী। বাংলাদেশে একাকী থাকা প্রবীণ মানুষের হালনাগাদ কোনো হিসাব নেই। তবে এ দেশেও এ রকম প্রবীণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

উপায় কী

প্রবীণদের আত্মহত্যা থেকে দূরে রাখতে উন্নত দেশগুলো এখন নানা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে। বছরের শুরুতে আলাদা মন্ত্রণালয় খুলেছে জাপান। নাম দিয়েছে একাকিত্ব মোকাবিলা মন্ত্রণালয়। ২০১৮ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ওই মন্ত্রণালয় চালু করে যুক্তরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তর প্রবীণ দেখভালে তরুণ-তরুণীদের দক্ষ করে তুলতে ‘ভরসা’ নামে এক প্রশিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রয়াসের সম্পূরক ভূমিকা ইতিমধ্যেই প্রবীণদের প্রশংসা পেয়েছে।

প্রবীণদের দারিদ্র্য আর একাকিত্ব মোকাবিলায় বয়স্ক ভাতা চালু করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ সালে প্রায় ৪৯ লাখ মানুষ এ সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া মাতা-পিতার দেখভালে সন্তানদের বাধ্য করতে পাস হয়েছে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’।

আসলে ভাতা ও আইনের পাশাপাশি প্রবীণদের ভালো রাখার ব্যাপারে সমাজেরও একটা দায়িত্ব আছে। দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে নাতি-নাতনির চিরকালীন মধুর সম্পর্ককে আবারও গড়ে তুলতে হবে। ভাঙা পরিবারে যা আজ আর দেখা যায় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক

nayeem 5508 @gmail.com