Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রবৃদ্ধির স্বস্তি, প্রবৃদ্ধির অস্বস্তি

বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দ্রুত হারে বড় হচ্ছে তা এখন সুস্পষ্ট। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার তিন বছর ধরে ৭ শতাংশের ওপরে রয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও এর প্রবৃদ্ধির হার চূড়ান্ত করেছে। এতে দেখা যায় যে গত অর্থবছরে জিডিপির তথা অর্থনীতির আয়তন দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, আর আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত ৭ দশমিক ৪০ শতাংশের চেয়ে বেশি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, যা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারকসহ বিভিন্ন মহল স্বাভাবিকভাবেই বেশ উচ্ছ্বসিত।

এই উচ্ছ্বাসে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চের হালনাগাদ একটি প্রতিবেদন। এতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রথম সারির ৭৫টি দেশ এখন থেকে এক যুগ পরে বা ২০৩০ সালে কে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার একটি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সেই প্রক্ষেপণ অনুসারে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে কিনা আগামী এক যুগ তো বটেই, এমনকি তার চেয়ে কিছু বেশি সময় ধরে প্রতিবছর গড়ে ৭ শতাংশের বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে।

এর ফলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম অর্থনীতির দেশ, এখন যে অবস্থানে আছে অস্ট্রিয়া। বর্তমানে জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির ৪২তম দেশ। ক্রমাগত উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে বাংলাদেশ এই এক যুগে বিশ্ব অর্থনীতির সারণিতে ১৬ ধাপ অগ্রসর হবে। ৭৫টি দেশের মধ্যে এটিই হবে সবচেয়ে বেশি অগ্রসর হওয়া।

কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হারই শেষ কথা নয়, নয় একমাত্র অভীষ্ট। এমনকি এটি এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচকও নয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণত প্রতিবছর, একটি দেশের ভেতরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাপ হলো জিডিপি, যা কিনা অর্থমূল্যে বা টাকার অঙ্কে প্রকাশিত হয়। এটি অর্থনীতির আকার বা পরিমাণ নির্দেশ করে। আগের বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে যে হারে এই পরিমাণ বাড়ে, তাই হলো প্রবৃদ্ধির হার।

তবে এই হার কতটা টেকসই তা নির্ভর করে কোন কোন উৎস এ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে তার ওপর। কারা এ প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগ করছে, তার মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধির গুণমান প্রতিফলিত হয়। নীতিনির্ধারক মহলের কাছে প্রবৃদ্ধির গুণগত দিকটি যথেষ্ট মনোযোগ কাড়তে পারেনি বলে মনে হয়, যদিও ইনক্লুসিভ গ্রোথ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা আছে। তবে প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হলে তাকে গুণগতভাবে ভালো বা উন্নতমানের হতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক কার্যপত্রে ২০১৪ সালে প্রবৃদ্ধির গুণমান সূচক তৈরির একটি রূপরেখা দেওয়া হয়। সেখানে ২০০৫-১১ সময়কালে বিশ্বের ৯৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রবৃদ্ধির গুণানুসারে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয় ৫০তম।

দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিমালায় উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার পেছনে যুক্তি হলো, উচ্চ প্রবৃদ্ধির ফলে অধিকসংখ্যক মানুষ আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে অর্থসম্পদের ভাগীদার হতে পারবে। এভাবে যত বেশি মানুষের হাতে অর্থ আসবে, তত বেশি মানুষ অভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

অভাব বা গরিবি থেকে এই বেরিয়ে আসা মানুষ নিজেই আগের চেয়ে উন্নততর জীবন যাপন করতে পারবে। এটা ঠিক যে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি না ঘটলে বা অর্থনীতি দ্রুত বড় হতে না পারলে বেশি মানুষকে উন্নততর জীবনযাপনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায় না। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবেই এগিয়ে চলেছে।

তবে এটাও প্রমাণিত যে শুধু উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি বিশ্বের বহু দেশেই গরিবি যথেষ্ট কমাতে পারেনি, পারেনি সমাজে আয়বৈষম্য কমাতে, বরং তা বাড়িয়েছে। আসলে গরিবি কমা বা আগের তুলনায় বেশি মানুষের উন্নততর জীবনযাপনের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া নির্ভর করে প্রবৃদ্ধির বণ্টনের ওপর। মানে, অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বাড়তি ধনসম্পদ তৈরি হচ্ছে তা কীভাবে ও কার মালিকানায় চলে যাচ্ছে, সেটি দেখতে হবে।

সনাতনী অর্থনীতি তত্ত্ব বলে যে প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে কিংবা ওপর থেকে নিচের দিকে চুইয়ে পড়ে। বাস্তবতা এই তত্ত্বকে পুরোপুরি সমর্থন করে না। বরং এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে সমাজের সুবিধাভোগী ও ক্ষমতাসীনেরাই প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেন। সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে থাকা অথচ জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তাই ভাগে কম পায়। এভাবে আয়বৈষম্য বাড়তে থাকে। আর সেটা প্রতিফলিত হয় জীবনযাত্রার মানে।

বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি এখনো সম্পদের সুসম বা ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে পারেনি, তা বিভিন্নভাবে সমাজে প্রতিফলিত হয়। একদিকে তৈরি পোশাকশিল্পের লাখ লাখ শ্রমিক ১০ হাজার টাকার সমপরিমাণ ন্যূনতম মজুরি থেকে এখনো অনেক দূরে রয়েছেন।

অন্যদিকে কয়েক হাজার উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা একেকজন স্কুলের টিফিনের জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা অনায়াসে খরচ করতে পারছে। একদিকে সামান্য হাঁচি-কাশিতে কেউ কেউ ছুটে যাচ্ছেন ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে, অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষ দেশের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় সুচিকিৎসা পেতে লড়ছে। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে।

আবার সামগ্রিকভাবেও প্রবৃদ্ধির গুণগত দিক উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। উচ্চ ব্যয়ে রাস্তাঘাট নির্মিত হচ্ছে। কিন্তু অনেক রাস্তাই অল্প দিন পরে ভাঙাচোরা রূপ নিচ্ছে নিচু মানের উপকরণ ব্যবহারের কারণে। এগুলো মেরামত করতে গিয়ে আবার অর্থ ব্যয় হচ্ছে।

এভাবে নির্মাণ ও মেরামত ব্যয় টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার বাড়াতে বা প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও ব্যয়ের সুফল বেশির ভাগ মানুষ পাচ্ছে না। তবে গুটিকয় মানুষ, যারা নিম্নমানের নির্মাণকাজ করে নিজেদের পকেট ভারী করতে পেরেছে (অবশ্যই অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে), তারা প্রবৃদ্ধি থেকে মাত্রাতিরিক্ত লাভবান হচ্ছে। এভাবেই প্রবৃদ্ধির গুণগত দিকটা এখন যেন অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে।

আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক