Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রশ্নপত্র ফাঁস: তুমিও ব্রুটাস?

‘আবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে! অনলাইনে একজন অর্থের বিনিময়ে গণিত প্রশ্ন বিক্রি করছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী সন্দেহে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।’ না! এই খবর বাংলাদেশের নয়! খবরটি খোদ যুক্তরাজ্যের। এ বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত এ-লেভেল পরীক্ষার গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন ৩০০ পাউন্ডে অনঅলাইনে কিনতে পাওয়া গেছে। শুধু এবারই নয়, গেল বছরও এ-লেভেল পরীক্ষার অর্থনীতি ও গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। এ বছর ভারতে সেন্ট্রাল বোর্ডের সেকেন্ডারি পরীক্ষার গণিত ও অর্থনীতি পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়লে ২৮ লাখ পরীক্ষার্থীকে আবার পরীক্ষা দিতে হয়। পাকিস্তান, নেপাল, মালোয়েশিয়া, মিসর, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকংসহ পৃথিবীর অনেক দেশেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটে। এর নিগলিতার্থ হলো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া কোনো আচানক বা বিরল ঘটনা নয়। তবে তাঁর মানে এই নয় যে আমাদের দেশে যেভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, তা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা।

দুই.
বাংলাদেশে কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে এখন কেউ চোখ কপালে তোলেন না। কারণ পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা সব পরীক্ষায় হামেশাই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বা ফাঁস হওয়ার গুজব শোনা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মান ও নিরপেক্ষতার সুনাম দীর্ঘদিন থেকেই ছিল। কিন্তু কয়েক বছর থেকেই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল, এখানে–সেখানে টুকিটাকি আলামতও নাকি পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ মানতে চায়নি। কিন্তু এ বছর ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া প্রমাণিত হওয়ার পর কেউ আশ্চর্য হয়ে বলতে পারে, ‘তুমিও ব্রুটাস?’
আমরা আশা করব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেবল আবার পরীক্ষা নিয়েই দায় সারবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কুশীলবদেরও শনাক্ত করবে। সরিষায় ভূত ঢুকেছে কি না, সেটিও অনুসন্ধাণ করবে।

তিন.
আমাকে একদিন আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে এত চেঁচামেচি কেন বলো তো? প্রশ্ন পেলে ছাত্রছাত্রী খুশি, তাদের ছাত্রের বাবা-মা এ জন্য টাকা দিয়ে খুশি, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ছাত্রবান্ধব শিক্ষকেরা স্বস্তিবোধ করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঠিকাদারি করে শুনেছি, ছাত্রনেতাদের ভালোই আমদানি হয়, প্রেসের লোকেরও হয়তো কিছু আয়রোজগার বাড়ে, কোচিং সেন্টার প্রশ্ন দিতে পারলে তাদের ছাত্র বাড়ে, থলি ভরে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তো সবাই খুশি। এখানে সবারই একটি প্রাপ্তিযোগ আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে আদর্শ “উইন, উইন সিচুয়েশন”। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পাসের হার বাড়ে, আমরাও দেশের শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে ভেবে পুলকিত হই। আসলে কারও উন্নতি দেখলেই এ দেশের মানুষের চোখ টাটায়।’ আমার এই বন্ধুর শ্লেষ মাখানো রসিকতায় অতিরঞ্জন ও সরলীকরণ থাকলেও প্রকৃত পরিস্থিতি এর চেয়ে খুব ভিন্ন নয়। দেশে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যবসা একটি ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে, কোচিং সেন্টার ইন্ডাস্ট্রির ‘সিস্টার কনসার্ন’। যেকোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা এখন এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।

চার.
যেকোনো ভর্তি পরীক্ষা বা নিয়োগ পরীক্ষার তুলনায় এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষা অনেক বড় একটি কর্মযজ্ঞ। একটি পাবলিক পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি করা থেকে পরীক্ষার হলে প্রশ্ন বিতরণ পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ থাকে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। থাকে হাজার হাজার লোকের সংশ্লিষ্টতা। তাদের চারদিকে এখন স্বার্থের আর অর্থের কালসাপ কিলবিল করে। ডিজিটাল ফোটোগ্রাফির ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থার উত্কর্ষ ও সহজলভ্যতার কারণে পুরোনো পদ্ধতির নিরাপত্তাব্যবস্থা যতই নিশ্ছিদ্র করা হোক না কেন বেহুলার বাসরঘরের মতো তার ভেতর ঘাতক কালনাগিনী ঢুকবেই। যেকোনো পর্যায়ে একজন অসৎ কর্মচারী কিংবা একজন নৈতিকতাবিবর্জিত শিক্ষক প্রশ্নের একটি ছবি ক্যামেরায় তুলে নিতে পারলেই তা নিমেষেই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এ কাজের জন্য বাতাসে যদি টাকা ওড়ে তবে কার না একটা সুযোগ নিতে ইচ্ছে হয়?

গত বছর এসএসসি পরীক্ষার সময় প্রায় প্রতিটি পরীক্ষার আগে আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরীক্ষার সঠিক–বেঠিক প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ছিল। বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে পরবর্তী এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের বিষয় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়। কিন্তু গতবারের পদ্ধতি যে প্রতিবারই কাজ করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দুর্বৃত্তেরা ঠিকই নতুন ফাঁকফোকর বের করে ফেলবে। তাই অ্যানালগ পদ্ধতি দিয়ে ডিজিটাল চুরি ঠেকানোর চেষ্টা না করে যত দ্রুত সম্ভব আমাদের আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি ও বিতরণ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি আদৌ জটিল নয়, ব্যয়বহুলও নয়। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মুদ্রণ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিতরণে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ দিয়েই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।

আশার বিষয় যে নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে পরীক্ষা নেওয়া যায়, তার প্রমাণ হাতের কাছেই আছে। যশোর শিক্ষা বোর্ড বেশ কয়েক বছর থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ডিজিটাল আইটেম বা প্রশ্নব্যাংক তৈরি করে তার সহায়তায় বোর্ডের আওতাভুক্ত সব স্কুলের ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করছে। এ বছর যশোর শিক্ষা বোর্ডের ২ হাজার ৮০০ স্কুলে নির্বাচনী পরীক্ষাও হয়েছে এই পদ্ধতিতে। এ জন্য প্রশ্নব্যাংক থেকে ১৭টি বিষয়ে পরীক্ষার পূর্ব দিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে উত্পাদিত নৈর্ব্যক্তিক ও সৃজনশীল প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর মাত্র ৩০ মিনিট আগে প্রতিটি স্কুলে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে আগেই ফটোকপি করে প্রশ্ন বিতরণ করা হয়েছে। টুকিটাকি ত্রুটি–বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই পদ্ধতি সনাতন পদ্ধতির অনেক উন্নত বিকল্প। বর্তমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠাও কঠিন নয়। ঢাকা বোর্ডসহ অন্যান্য বোর্ডও একই লাইনে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও নানা বিকল্প নিয়ে কাজ করছে।

তবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে গেলেও যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি সম্পূর্ণ তিরোহিত হবে না, সে বিষয়ে আমরা প্রথমেই আভাস পেয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি বর্তমান মান্ধাতা আমলের পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য হবে।

পাঁচ.
আগে পাওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে কোনো পাপবোধ নেই—এমন শিক্ষার্থী সব সময় এ দেশে ছিল। ছেলে চুরি-চোট্টামি করে পাস করলে লজ্জিত হয় না এমন বাবা-মাও সমাজে ছিল। কিন্তু আমদের সমাজে নৈতিকতার অগস্ত্য যাত্রা ও দুর্নীতির মাধ্যমে ‘হঠাৎ ধনীদের’ সংখ্যাস্ফীতির ফলে এ ধরনের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা এখনো নিতান্তই সংখালঘু। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে আমরা এখনো বলতে পারি, ‘আমাদের সমাজে ভাল লোকেরই প্রাধান্য/মন্দ যদি তিন চল্লিশ, ভালর ভাগ সাতান্ন।’

তাই আমি এমন বালককেও জানি যে সতীর্থের দেওয়া পরীক্ষার প্রশ্ন প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ‘আগে প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করব? তাতে কার গৌরব বাড়বে জানি না, কিন্তু আমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে।’

এ ধরনের সুশীল ছেলেমেয়েরাই দেশে এখনো সংখ্যাগরিষ্ট। সেটাই আশার কথা।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ। প্রাবন্ধিক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব।