Thank you for trying Sticky AMP!!

ফরাসি বিদ্রোহ, ইউরোপে পরিবর্তনের আভাস

প্যারিসের দেয়ালে ফরাসি বিপ্লবের প্রতীক দেলাক্রোয়ার আঁকা ‘লিবার্টি’ চিত্রের অনুকরণে আঁকা চলতি ফরাসি হলুদ জ্যাকেট আন্দোলনের চিত্র।

সপ্তাহান্তেই ফ্রান্সে হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন চলছে। গত শনিবারও ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে হলুদ জ্যাকেট পরিধান করে বিক্ষোভ করেছেন হাজারো মানুষ। বিভিন্ন শহর থেকে তিন শতাধিক আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়েছে। সদ্য বিদায়ী বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে পথে নেমেছেন হলুদ জ্যাকেটধারীরা। আন্দোলনের মুখে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারসহ অবসর ভাতা ও অতিরিক্ত কাজের ওপর কর বাতিলের ঘোষণা দিলেও বশ মানেননি আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীরা বলছেন, জীবনযাত্রার খরচ সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। সামগ্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত স্বল্প ও মাঝারি আয়ের মানুষ ধুঁকছেন। মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকশ্রেণির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ব্যয় বেড়েছে। আয় সেই অনুপাতে বাড়েনি। ইউরোপের সাধারণ মানুষ ভালো নেই।

কেন ভালো নেই, সেটা বলার আগে একটি ঘটনার কথা বলি। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে ইউরোপের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী? এই ঘটনা এক বাংলাদেশির কাছ থেকে শুনেছি। ওই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক প্রায় ১৫ বছর ধরে ইতালি থাকেন পরিবারসহ। রোম শহরে তাঁর একটি ফলের দোকান আছে। দোকান ফেলে তিনি জার্মানি এসেছিলেন চাকরির খোঁজে। ওই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বিবরণ অনুযায়ী কোনো এক সকালে অনেক সময় নিয়ে ঘুরেফিরে ইতালীয় এক বৃদ্ধা তাঁর দোকান থেকে একটি আপেল কিনে নিলেন। এই ইতালীয় বৃদ্ধাকে তিনি প্রায় পাঁচ বছর ধরে চেনেন। কোনো দিনই তাঁকে একটি আপেল কিনতে দেখেননি। কিন্তু এখন ইতালির অবস্থা বদলে গিয়েছে। অনেক ইতালীয় এখন বাজারে গিয়ে অনেক কিছু ভাবেন; বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনসাধারণ। শুধু ইতালিই কেন? ইউরোপের অনেকই দেশেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যক্তিগত বাজেট কাটছাঁট করতে হয়। আয়–ব্যয়ের অসামঞ্জস্যের কারণে মাঝেমধ্যেই ফুঁসে উঠছে ইউরোপের সাধারণ লোকজন।

ফ্রান্সের হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন এর সর্বশেষ নজির। এখন এই আন্দোলন শুধু জ্বালানি তেলে মূল্যবৃদ্ধির জায়গায় থেমে নেই; জীবনমানের প্রাসঙ্গিক অনেক কিছুই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মূল বিষয় হচ্ছে ইউরোপে পালাবদল করে যারা ক্ষমতায় আসে, যেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অর্থনৈতিক নীতির পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। মধ্যবাম বা মধ্যডান বলে পরিচিত দলগুলো মুনাফামুখী পুঁজিবাদের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, এসব সরকারের নতুন নতুন নীতি বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও শ্রমজীবী, চাকরিজীবী সাধারণের কাছে অপ্রিয়। বেকারত্ব বাড়ছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সুবিধা কমছে। মাথার ওপর হাজারো করের বোঝা। আবার সরকারগুলো বলছে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে। এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছে ইউরোপের অর্থনীতি। এসবের কোনো সমাধান সরকারগুলো দিতে পারছে না।

ধারণা করা হচ্ছে, ফ্রান্স ছাড়াও এই আন্দোলন ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিছুদিন আগে জার্মানির বন শহরে বাড়িভাড়া হ্রাসের দাবিতে তরুণেরা মিছিল করেছেন। সেই মিছিলে আমিও ছিলাম। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া ওই সব তরুণের বক্তব্য, আমরা আর কুলিয়ে উঠতে পারছি না। পুঁজিবাদের এক ভয়াল থাবায় সারা বিশ্বই আজ অস্থির।

এই অস্থিরতার আভাস বাংলাদেশ ও ভারতেও দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকেরা অধিকতর সুযোগ-সুবিধার দাবিতে পথে নেমে এসেছিলেন। ভারতেও শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালন করেছেন। গত কয়েক মাসে ভারতের বড় বড় শহরে কৃষকদের সমবেত হওয়ার সংবাদ আমরা দেখেছি।

ইউরোপ পরিবর্তনের এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকেই ধারণা করছেন, ইউরোপে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন আসন্ন। শ্রমিকশ্রেণি দক্ষিণপন্থী দলগুলোর দিকে ভিড়ছে মিষ্টি মিষ্টি প্রতিশ্রুতি শুনে। মধ্যবিত্ত প্রেকাতারিয়েতরা সেটা করতে পারছে না। আবার মধ্যবাম বা মধ্যডানদের পছন্দ করছে না। কারণ, মধ্যবাম ও মধ্যডানরা উচ্চবিত্ত, পুঁজিবাদীদের দলে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন, পরিবেশেবাদী আন্দোলন বা জি-২০ বিরোধী আন্দোলনে নতুন এক রাজনৈতিক শ্রেণির বিকাশের আভাস পাওয়া যায়।

ইউরোপে প্রেকাতারিয়েতরা নিজেদের পরিচয় গঠন করছে। পুঁজিবাদী সমাজে মূলত তিনটি শ্রেণি থাকে—শ্রমিক, বুর্জোয়া, জমিদার। আধুনিক ইউরোপেও এই তিন শ্রেণি এখনো সক্রিয়। এখানে শ্রেণি বিভাজন পরিষ্কার। কিন্তু এটিকে অনেক সময় ভুলভাবে হাজির করা হয়। তাই প্রলেতারিয়েতরাই পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার না। সমাজ থেকে সব সময়ই বিপ্লবী বা পরিবর্তনকামী অংশ বেরিয়ে আসবে। এরা সমাজের সচেতন অংশ। নতুন রাজনীতি বিনির্মাণ করবে এই নতুন শ্রেণি। বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে এই পরিবর্তনকে। বাস্তবে ইউরোপে চাকরি হারিয়ে উচ্চশিক্ষিত বেকার লড়াই করছে। কিন্তু এরা প্রলেতারিয়েত না। এরা প্রেকাতারিয়েত। আবার বাংলাদেশ ও ভারতে শ্রমিক–কৃষকেরা পথে নেমেছেন। কিন্তু এঁরা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ভূমিকা রাখতে পারবেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। মোদ্দাকথা, ইউরোপ বা আমাদের দেশে যা হচ্ছে, তা কোনো কমিউনিজমের আন্দোলন না; অধিকতর মুক্ত মানুষ হওয়ার লড়াই। ভবিষ্যতে করপোরেট পুঁজিপতিদের সঙ্গে শিক্ষিত প্রেকাতারিয়েতদের লড়াই হবে। প্রেকাতারিয়েতরাই সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য আনয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। এদের সঙ্গে শ্রমিক–কৃষকরাও থাকবেন। আর এরা যত দিন ঘুমিয়ে থাকবে, ততই রাজনীতির মঞ্চ পুঁজিপতি স্বৈরশাসক, একনায়কদের দখলে চলে যাবে। চরম লোকরঞ্জনবাদীদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকবে। যার পেছনে থাকবে করপোরেট পুঁজিপতিরা। তাই প্রেকাতারিয়েতদের জেগে ওঠা যেমন জরুরি, প্রেকাতারিয়েতদের বুঝতে পারাও তেমনই জরুরি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য। মধ্যবাম, মধ্যডান, চরম বাম, চরম ডান—সবার জন্যই এখন জরুরি বিষয় এটি।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন