Thank you for trying Sticky AMP!!

ফাউ টিকিটে 'আকাশে শান্তির নীড়'

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ফাইল ছবি

পাগলা কিসিমের লোকটার নাম মিশেল লতিতো। বাড়ি ফ্রান্সে। ভাত, রুটি তেমন খেতেন না। চামড়া, প্লাস্টিক, কাচ, লোহালক্কড়—এসব হাবিজাবি খেতেন। পেটে কোনো গন্ডগোল হতো না। ‘শ্রীপুরের বড়ি’ ছাড়াই দিনে এক কেজি লোহা খেয়ে ‘হজম’ করে ফেলতেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ঠিক করলেন আস্ত একটা প্লেন চিবিয়ে খাবেন। ওই বছরই ‘সেসনা-১৫০’ মডেলের একটি এয়ারক্র্যাফট খাওয়া শুরু করে দিলেন তিনি। ভেঙে ভেঙে প্রতিদিন একটু একটু করে খেতে লাগলেন। ১৯৮০ সালের আগেই গোটা এয়ারক্র্যাফট লতিতোর পাকস্থলী হয়ে সোজা টয়লেটের কমোডে চলে গেল।

‘মিস্টার ইট-অল’খ্যাত এই সর্বভুক ‘মহামানব’ গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়ে ২০০৭ সালের ২৫ জুন দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। আস্ত বিমান চিবিয়ে খাওয়ার মতো মহান বিদ্যা তিনি কাউকে শিখিয়ে যাননি—এই নিয়ে জগৎবাসীর হা-পিত্যেশ ছিল। বিরাট আমোদ-আল্লাদের কথা হলো, আমাদের এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপেই মিশেল লতিতোর ‘একপাল’ উত্তরসূরি পাওয়া গেছে। লতিতো সামান্য একটা ছোট বিমান খেয়েছিলেন, আর তাঁরা একটা বিমান সংস্থাকেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলার কোশেশ করে যাচ্ছেন। সরকারি সংস্থা ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস’-এ তাঁরা চাকরি করেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিঃস্বার্থ অবদানের সুবাদেই বাংলাদেশ বিমান নিয়ে যখন কথা ওঠে, তখন যে দুটো শব্দ অনিবার্যভাবে উঠে আসে, তার একটি হলো ‘লোকসান’, অন্যটি হলো ‘দুর্নীতি’। কিছুদিন পরপরই বিমানের লুটপাট, দুর্নীতি, অনিয়ম, লোকসান—এসব নিয়ে খবর বেরোয়। এসব বিমানের গা–সওয়া হয়ে গেছে। আমাদেরও।

এবার যে খবরটি এসেছে সেটি বাংলাদেশ বিমানের কর্মীদের ‘উলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই’ নীতিভিত্তিক ভাবমূর্তিকে আরও মিনিমাম ৩০ হাজার ফুট বেশি উচ্চতায় নিয়ে গেছে। খবর বেরিয়েছে, গত ১০ বছরে বিমান নিজেদের কর্মীদের প্রায় ৪৮ হাজার টিকিট দিয়েছে। এর মধ্যে কিছু টিকিট ‘প্রায় ফাউ’ (৮৫ শতাংশ ছাড়) এবং কিছু ‘পুরো ফাউ’ (১০০ শতাংশ ছাড়)। এই ‘প্রায়’ এবং ‘পুরো’ ফাউ টিকিটের মূল্য মাত্র ৭০ কোটি টাকা। মানে তাঁরা বছরে প্রায় ৭ কোটি টাকার ‘প্রায়’ ও ‘পুরো’ ফাউ টিকিট ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। নিজের বা স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানদের নামে তাঁরা এসব টিকিট নিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, প্রকৌশল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট শাখার কর্মীরা সবচেয়ে বেশি মাগনা টিকিট নিয়েছেন। এই শাখার ৫৫১ জন কর্মী নিয়েছেন ১০ হাজার ৮৪৮টি টিকিট। অন্য বিভাগের মধ্যে ফ্লাইট পরিচালন শাখার একজন কর্মকর্তা একাই নিয়েছেন ৩৩৮টি টিকিট। একই বিভাগের আরেকজন নিয়েছেন ১৭৩টি টিকিট। অর্থ পরিদপ্তরের এক কর্মকর্তা একাই নিয়েছেন ১৭০টি টিকিট। একজন কনিষ্ঠ বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নিয়েছেন ১৪২টি টিকিট। ট্রাফিক বিভাগের একজন গ্রাউন্ড সার্ভিস সুপারভাইজার নিয়েছেন ১৫০টি। এই ‘ত্যাগী’ কর্মীদের গোটা লিস্টি বেশ লম্বা।

ফ্লাইট পরিচালন শাখার যে কর্মকর্তা ১০ বছরে ৩৩৮টি ‘ফাউ’ টিকিট নিয়েছেন, তাঁর কথাই ধরা যাক। তিনি গড়ে বছরে নিয়েছেন প্রায় ৩৪টি এবং মাসে নিয়েছেন প্রায় তিনটি টিকিট। তার মানে টানা ১০ বছর ধরে তিনি এবং তাঁর মতো ম্যালা কর্মী পরিবার–পরিজন নিয়ে পাবলিকের টাকায় ‘আকাশে শান্তির নীড়’ ভোগ এবং উপভোগ দুটোই করে এসেছেন। ইকারুসের ডানায় তাঁরা ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ দেখে বেড়িয়েছেন।

অথচ বিমানের হিসাব শাখার তথ্য বলছে, বিগত ৯ বছরে সংস্থাটি লোকসান করেছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে দেনা আছে আড়াই হাজার কোটি টাকার ওপরে। শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি এখন মূলধন সংকটে। মূলধনের চেয়ে ঋণ কয়েক গুণ বেশি হওয়ায় এটি ঋণ পাওয়ার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছে।

এই অবস্থার মধ্যেও বিমানকর্মীদের খোলামকুচির মতো টিকিট দেওয়ার সঙ্গে লোকাল বাসের ‘স্টাফ’দের মাগনা যাতায়াতের বিরাট মিল পাওয়া যাচ্ছে।

বিমানকর্মীরা বলতেই পারেন, যেখানে বিমানের হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে, সেখানে ফাউ টিকিটে বালবাচ্চা নিয়ে একটু ওড়াউড়ি করা এমন কী ঘটনা? তা ছাড়া, বেআইনিভাবে কেউ তো টিকিট ফাউ নেননি। বিমান তাঁদের এই সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখে আগেই নীতিমালা করেছে। সেই নীতিমালার আলোকে টিকিট নিয়েছেন তাঁরা।

তাঁরা বলতে পারেন, যা করা হয়েছে-হচ্ছে-হবে, তার সবই নীতিমালা মানে আইনের মধ্যে থেকেই হয়েছে-হচ্ছে-হবে। আইনের হাত বিরাট ‘লম্বা’, তার ওপর তার একটি ‘গতি’ আছে। সেই গতির নাম ‘নিজস্ব গতি’। লম্বা হাতযুক্ত আইনের ‘নিজস্ব গতি’ দিয়ে এসব টিকিট নেওয়া হয়েছে। এই মাগনা ওড়াউড়ির নীতি ঠেকাতে হলে আগে নীতিমালা ঠিক করা দরকার।

সারা বছর লোকসান করা বিমানের নীতিমালায় কর্মীদের জন্য বিভিন্ন রেয়াতি টিকিট রাখা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক গন্তব্যে একেকজন (নির্ভরশীলসহ) বছরে ৮৫ থেকে ১০০ শতাংশ রেয়াতি হারে সর্বোচ্চ ২০টি টিকিট প্রাপ্য হন। এই রকমের একটা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের নীতি রাখা আর মিশেল লতিতোর প্লেন টুকরো টুকরো করে চিবিয়ে খাওয়ার মধ্যে নীতিগত তফাত আছে বলে মনে হয় না। তার চেয়ে বড় কথা হলো নীতিমালায় যা-ই থাকুক, নৈতিকতা বলে তো একটা কথা আছে। মামার বাড়িও তো মানুষ এত মাগনা টিকিটের আবদার নিয়ে যায় না!

 সংবাদপত্রে দেখলাম এভাবে টিকিট দেওয়াকে ‘ঢালাও ও অযৌক্তিক’ বলে মনে করছে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংসদীয় কমিটি। এ–সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, এমনিতেই বাংলাদেশ বিমান লোকসানে চলছে। এর মধ্যে নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢালাওভাবে বিনা মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে টিকিট দেওয়া হচ্ছে। এটি যথাযথ নয়। এটি পর্যালোচনা করা উচিত।

নিজস্ব কর্মীদের এভাবে বিশাল ছাড়ে টিকিট দেওয়ার নীতিমালা পরিবর্তন করা উচিত বলে মনে করেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক। তিনি বলেছেন, ঢালাওভাবে টিকিট দেওয়া যাবে না। নীতিমালায় কী আছে, তা দেখে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেবে।

গত ১০ বছরের ‘উলটপালট’ অবস্থা ‘একটি নির্দেশনায়’ সোজা হবে, সেই আশা করার লোক এই দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তা দেখতে বাটি চালান দেওয়া যেতে পারে।

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin.ahmed@prothomalo.com

আরও পড়ুন:
৮৫ থেকে ১০০% ছাড়ে বিমান টিকিট