Thank you for trying Sticky AMP!!

ফয়েজকন্যার সঙ্গেও এই আচরণ!

মনিজা হাশমি

পাকিস্তানের প্রখ্যাত কবি ও বুদ্ধিজীবী ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ যতবার ভারতে এসেছেন, ততবারই তাঁকে সাদর আলিঙ্গনে কাছে টেনে নেওয়া হয়েছে। তাঁর দুই মেয়ে সালিমা ও মনিজা হাশমির ক্ষেত্রেও কখনো এর ব্যত্যয় হয়নি। দিল্লি কখনো তাঁদের আসা-যাওয়ায় বাধা দেয়নি। বরং তাঁদের উপস্থিতিকে দিল্লি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল চেতনার বিজ্ঞাপন হিসেবে এত দিন তুলে ধরে এসেছে।

আসলে পাকিস্তানের প্রগতিশীলদের নির্বিঘ্ন ভারত ভ্রমণ ভারতের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদারতার জায়গাটিকে পোক্ত করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে দিল্লির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। সীমান্ত পারাপারের জন্য দুই দেশের প্রগতিশীল মানুষের বিশেষ উপলক্ষের দরকার হয়নি। সালিমা ও মনিজার ক্ষেত্রেও ভারত এত দিন সে রকমই আচরণ করে এসেছে। তাঁরা তাঁদের নিজেদের উদ্যোগ এবং উপলক্ষ নিয়ে বারবার ভারতে এসেছেন। কোনো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, চিত্র প্রদর্শনী, কোনো সংগীত আয়োজন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে তাঁরা অতিথি হয়ে এসেছেন। সাধারণত দুই বোন একসঙ্গেই ভারতে আসেন।

দক্ষিণ এশিয়ার ঐক্য উদ্যাপন করার জন্য কয়েক বছর আগে শ্রীনগরে বিভিন্ন দেশের লেখক-সাহিত্যিক জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে সালিমা এবং তাঁর স্বামী শোয়েব হাশমির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। ভারত-পাকিস্তান শান্তির অন্যতম সমর্থক চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা (শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট) ওই আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। ডন পত্রিকায় ছাপা হওয়া আমার কলামের সঙ্গে সালিমা পরিচিত ছিলেন। আর শোয়েবের লেখার সঙ্গেও আমি আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম। শেখ আবদুল্লাহ শ্রীনগরের যে বাড়িতে ফয়েজ ও আলিশের (সালিমা ও মনিজার বাবা-মা) বিয়ে পড়িয়েছিলেন, অনুষ্ঠান শেষে আমরা সেই বাড়ি ঘুরে দেখেছিলাম।

মনিজার সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয় দিল্লিতে তাঁর ছেলে আলী মাদিহ হাশমির একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে। আলীর টুইট থেকেই প্রথম জানলাম, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মনিজাকে দিল্লিতে একটি সম্মেলনে বক্তব্য দিতে নিষেধ করা হয়েছে। আমার মনে হয়, যদি কংগ্রেস সরকার মনিজার সঙ্গে এই আচরণ করত, তাহলে এটি ধাক্কা খাওয়ার মতো বিষয় হতো। কিন্তু মোদি সরকারের কথা একেবারেই আলাদা। মোদি সরকার যে চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তুলনা করলে তার সঙ্গে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের ইসলামীকরণের মিল পাওয়া যায়। জেনারেল জিয়ার আদলে ২০১৪ সাল থেকে মোদি সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে রাজপথে তাদের গোঁড়ামি ছড়িয়ে আসছে।

জিয়ার শাসনামলে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ কোথায় আশ্রয় নিয়েছিলেন? তিনি বৈরুত কিংবা মস্কো যাননি। তিনি ছিলেন এই দিল্লিতেই। তাঁর পক্ষে কি সে সময় পাকিস্তানে স্বাধীনভাবে বাস করা সম্ভব ছিল? এর সোজা জবাব হলো, ‘না।’ তাহলে মনিজাকে একই ধরনের মতাদর্শে বিশ্বাসী মোদি সরকার বক্তব্য দিতে বাধা দিলে সেটি ব্যতিক্রম ঘটনা হবে কেন?

তবে একসময় পরিস্থিতি একটু ভিন্ন ছিল। জিয়ার আমলে যখন পাকিস্তানে গোলমাল লাগা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের সামরিক সরকারের হুমকিতে থাকা যেকোনো লোকের জন্য ভারতের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ পত্রিকার সালামত আলীকে জেনারেল জিয়ার হাত থেকে পালিয়ে আসা সাংবাদিক হিসেবে ভারতের গণমাধ্যম সাদরে গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানের শক্তিশালী লেখক ফাহমিদা রিয়াজ তাঁর ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে দিল্লিতে এসে উঠেছিলেন। তখন এ রকমই ছিল দিল্লি।

কিন্তু বাজপেয়ি সরকারের আমলে একদিন ফাহমিদাকে জীবন নিয়ে পালাতে হয়েছিল। একদিন জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে তিনি তাঁর লেখা একটি কবিতা পড়ছিলেন। পাকিস্তানের জ্ঞাতি ভাইদের মতো ভারতীয়রাও কীভাবে বোকামি করে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলছে-সেটি ছিল তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। ফাহমিদার সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানের আরেক বিখ্যাত কবি আহমেদ ফারাজ। ফাহমিদা কবিতাটি পড়ার সময় দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ একজন খুব খেপে গেলেন এবং পিস্তল বের করে তাঁর দিকে তাক করলেন। ফাহমিদা ও ফারাজ দ্রুত সরে গেলেন এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এরপর থেকে তাঁদের চুপই থাকতে হয়েছে।

সালিমা ও মনিজাকে দিল্লিতে যিনি সব সময় আতিথেয়তা দেন, তিনি হলেন ধরম বীর। ধরম বীর সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট। মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর কাছের লোক ছিলেন।

গত মাসে রাজ্যসভা থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক কমিউনিস্ট ডি পি ত্রিপাঠীও উদারপন্থী পাকিস্তানিদের ভারতে সভা-সেমিনার করতে সহায়তা দানকারীদের একজন। মনিজার ভিসা নিয়ে জটিলতার পর তিনি প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভারতে তাঁদের মতো মানুষের সংখ্যা কি কমে যাচ্ছে?

ফয়েজ আহমেদ বলতেন, শিকল-বেড়ি পরা পা নিয়েই মানুষকে পথে নামতে হবে। নির্ভয়ে হৃদয়ের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে হবে। নইলে সবাই বিপথে যাবে।

ডন পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

জাবেদ নাকভি: ডন পত্রিকার দিল্লি প্রতিনিধি