Thank you for trying Sticky AMP!!

বছরে এক দিন 'স্বেচ্ছাশ্রম দিবস'

গত বছর সেপ্টেম্বরে মার্কিন সিনেটে সুপ্রিম কোর্টের নতুন বিচারপতি ব্রেট কাভানার কাছে প্রশ্ন ছিল, এই কাজে তাঁর যোগ্যতা কী। কাভানা অনেক ফিরিস্তি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি দিয়েছিলেন সবচেয়ে গর্বের সঙ্গে। তিনি প্রতি সপ্তাহান্তে নিজের কন্যার স্কুলের বাস্কেটবল টিমের ভলান্টিয়ার কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কথাটা বলার সময় তাঁর মুখে এক গভীর তৃপ্তির ছাপ ছিল।

স্বেচ্ছাশ্রম মানে নিজের ব্যক্তিগত সময়ে কোনো আর্থিক বা দৃষ্টিগ্রাহ্য সুবিধা ছাড়া সাধারণের উপকার হয়, এমন কাজে হাত লাগানো। নিজের এলাকার রাস্তাটা ভাঙা পড়ে আছে, সরকারের জন্য অপেক্ষা না করে সবাই মিলে সেটা সারানো। অথবা নিজের স্কুলের দেয়ালের রং-পলেস্তারা খসে গেছে, পুরোনো ছাত্ররা সবাই মিলে তা ঘষেমেজে সাফসুতরা করা। আপনি ডাক্তার, সপ্তাহে অথবা মাসে এক দিন কোনো ফি ছাড়া রোগী দেখে দিলেন। শহরের লাইব্রেরিটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে, আপনি ক্যাটালগিং জানেন। ঠিক আছে, অন্য কেউ না করুক আপনিই বইগুলো সাজিয়ে দিলেন। অথবা কাভানার মতো নিজের পাড়ার স্কুলে ক্রিকেট বা ফুটবল কোচের দায়িত্ব মাথায় তুলে নিলেন। এসবই স্বেচ্ছাশ্রমের উদাহরণ।

আমাদের চরিত্রে স্বেচ্ছাশ্রমের কোনো বালাই নেই। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমার জন্য নগদ কী আছে, সবার আগে সেটাই আমরা ভাবি। আমার জানা নেই বাংলাদেশের কোনো বিচারপতি বা ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তা, অথবা কোনো পত্রিকার সম্পাদক বা অধ্যাপক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া—কাউকে জানান না দিয়ে—কখনো কোনো স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছেন কি না। গ্রামেগঞ্জে অবশ্য ভাঙা সেতু নির্মাণ বা নদীর ভাঙা ঠেকাতে স্বেচ্ছাশ্রম পরিচিত অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেখানেও নিজের ঘাড়ে বিপদ এল বলে তড়িঘড়ি করে ছোটা। এর পেছনে স্বেচ্ছাশ্রমের আসল ‘স্পিরিট’ নেই। ধর্মীয় সংস্থায় আমরা অনেকেই শুধু টাকাপয়সা নয়, বিস্তর সময়ও দিয়ে থাকি। কিন্তু সেখানে আখিরাতে পুরস্কৃত হওয়ার হাতছানি থাকে।

আমাদের দেশে অবশ্য ভলান্টারি সংস্থার অভাব নেই। আমরা খুব ভালো করেই জানি, নামে ভলান্টারি হলেও এসব সংস্থার ভেতরে ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ বলে কিছু নেই। সবই নগদ—অনেক সময় বিদেশি পাওনা। যেকোনো স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক সংস্থার হিসাবের খাতা খুলে দেখুন। শুধু গাড়ি বাবদ কী খরচ হয়েছে তাতেই স্বেচ্ছাশ্রমের গুমর ফরসা হবে। আমার জানা, একসময় জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশের এক নামজাদা ভলান্টারি সংস্থার প্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি বিজনেস ক্লাসে টিকিট না পেলে আসবেন না, সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। এই অভ্যাসের ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো শুধু নিয়মকে সুনিশ্চিত করে, তা–ই না?

স্বেচ্ছাশ্রমের একটা উদ্দেশ্য সবার কল্যাণ হয় এমন ‘পণ্য’ সৃষ্টি। ইংরেজিতে এর নাম ‘কমন গুড’। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। নিউইয়র্কে আমার উপশহরে একটি ‘কমিউনিটি সবজির বাগান’ রয়েছে। জায়গাটা সরকারি, স্থানীয় লোকজন মিলে ঠিক করল, তারা সবাই মিলে একটা সবজি বাগান গড়ে তুলবে। পাড়াতেই উদ্যান বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, ল্যান্ডস্কেপ করেন এমন লোকও রয়েছেন। সবাই হাত লাগিয়ে রাতারাতি বাগান হয়ে গেল। বলা থাকল, যে কেউ এই বাগান থেকে সবজি নিতে পারবে, কারও কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই। যার সময়-সুযোগ হবে, সে এসে বাগানে জল দেওয়া বা লতাগুল্ম সাফ করতে হাত লাগাবে। শীতকালের কয়েক মাস ছাড়া সে বাগান থেকে এখন ধারেকাছের মানুষ বছরভর সবজি পাচ্ছেন।

পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বেচ্ছাশ্রম একটি খুবই পরিচিত অভিজ্ঞতা। জন হপকিন্স সেন্টারের এক গবেষণায় দেখছি, পৃথিবীতে ৩৭টির মতো দেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষ কোনো না–কোনো রকম স্বেচ্ছাশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। এরা যৌথভাবে যে ‘কমন গুড’ সৃষ্টি করে, হপকিন্সের হিসাবে তার মূল্যমান প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার। রাশিয়ায় দেখেছি, সেখানে মাসের কোনো কোনো শনিবার ‘সুব্বোতনিক’ পালনের চল রয়েছে। সুব্বোতা বা শনিবার থেকে এই সুব্বোতনিক। অক্টোবর বিপ্লবের পর ১৯১৯ সাল থেকে এই সুব্বোতনিকের চল শুরু। ছাত্র হিসেবে আমাকেও সেখানে মহা আনন্দে এই সুব্বোতনিকে অংশ নিতে হয়েছে।

আমেরিকায়, যেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের চল খুবই ব্যাপক, প্রতিবছর প্রায় ছয় কোটি মানুষ কোনো না–কোনো রকম কোনো আর্থিক সুবিধা ছাড়াই ‘কমন গুড’ সৃষ্টির কাজে অংশ নিয়ে থাকেন। এদের সৃষ্ট কমন গুডের ডলার মূল্যমান—ঢোঁক গিলুন—বছরে ১৫০ বিলিয়নের বেশি। আমি জেনে অবাক হয়েছি, এ দেশে অধিকাংশ অগ্নিনির্বাপক বা ফায়ার ফাইটার স্বেচ্ছাসেবী। শুধু আমেরিকায় কেন, পশ্চিমের অনেক দেশেই একই অবস্থা। যেমন জার্মানিতে প্রায় সব ফায়ার ফাইটার—বস্তুত ৯৭ শতাংশ—স্বেচ্ছাসেবক।

আর্থিক সুবিধার কথা ছেড়ে দিলাম, একদল মানুষ একজোট হয়ে কোনো সাধারণ কল্যাণকর কাজে হাত লাগাচ্ছে, তার সামাজিক মূল্য কোনো টাকা বা ডলারে হিসাব করে ওঠা অসম্ভব। আমরা সবাই গণতন্ত্র-গণতন্ত্র বলে চেঁচাতে ভালোবাসি। কিন্তু গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি পূর্বশর্ত হলো নাগরিক অংশগ্রহণ, ইংরেজিতে ‘সিভিক এনগেজমেন্ট’। স্বেচ্ছাশ্রম এই নাগরিক অংশগ্রহণের একটি প্রয়োজনীয় সেতু হতে পারে।

আমরা সবাই যে স্বেচ্ছাশ্রমে অনাগ্রহী, সে কথা আমি বলি না। কেউ একজন ডাক দিলে অনেকেই হয়তো এগিয়ে আসবেন। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার এই কাজটা কে করবে? আমেরিকায় দেখেছি স্থানীয় চার্চ বা সিনাগগ থেকে নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোও উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এমনকি ফেডারেল পর্যায়েও উদ্যোগ রয়েছে। এ দেশে মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের জন্মদিন উপলক্ষে জানুয়ারির তৃতীয় সোমবার জাতীয় সেবা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে দেখেছি জামার হাতা গুটিয়ে রং গোলাতে। জাতিসংঘ থেকেও প্রতিবছর ২৩ জুন ‘পাবলিক সার্ভিস ডে’ হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে কোনো পাবলিক সার্ভিস ডে রয়েছে বলে শুনিনি। যদি থেকেও থাকে তার ব্যাপক উদ্‌যাপন নেই। আমার একটি প্রস্তাব রয়েছে। প্রতিবছর ১৭ মার্চ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সেবা দিবস হিসেবে পালন করা হোক। দিনটি নানা উৎসব-আয়োজনে আমরা ব্যয় করে থাকি। সেসব থাক, তাতে কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু তার সঙ্গে যদি নাগরিক কল্যাণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রমের একটি উদ্যোগ নেওয়া যায়, তাহলে কী অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি, একবার ভাবুন তো? ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহরের একটি। দুই কোটি মানুষের বাস এ শহরে, তাদের একাংশকেও যদি উৎসাহিত করা যায়, কয় দিন লাগে এ শহরের নোংরা চেহারাটা বদলে দিতে? বড় কোনো কাজের কথা না হয় বাদ দিলাম। আর কিছু না হোক, যার যার পাড়াকে তো আমরা সাফসুতরা করতে পারি।

দক্ষিণ আফ্রিকায় এ রকম একটি স্বেচ্ছাশ্রম দিবস উদ্‌যাপিত হয় ১৮ জুলাই। দিনটি নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন। জীবনের ২৭ বছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন, সে কথা মাথায় রেখে সেখানে প্রতিবছর ১৮ জুলাই প্রত্যেককে অন্তত ২৭ মিনিট সাধারণের কল্যাণে ব্যয়ের আহ্বান জানানো হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। জাতির জনকের সেই ত্যাগের স্মরণে আমরাও কি পারি না বছরে একটা দিন বা তার অংশ সাধারণের কল্যাণে ব্যয় করতে?

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি