Thank you for trying Sticky AMP!!

বর্জনপীড়িত কমিশনও চায় রাজনৈতিক সমঝোতা

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেওয়ার পর ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা’র অঙ্গীকার করে বলেছেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘সমঝোতা সৃষ্টির’ অনুরোধ করবেন। সুন্দরভাবে নির্বাচনটা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চুক্তির কথাও তিনি বলেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের সময় সম্ভবত তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে তাঁর মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় অর্ধেকই অংশ নেয়নি। তারা ওই বাছাই প্রক্রিয়াকে ক্ষমতাসীন দলের পছন্দকে বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করেছিল। আগের দুটি কমিশনের সঙ্গে নতুন কমিশনের ফারাক বিচার করলে যে বিষয় অবশ্যই বলতে হবে, তা হলো আউয়াল কমিশন গঠিত হয়েছে আইন অনুসারে, কিন্তু অনুসন্ধান প্রক্রিয়া ছিল বর্জনপীড়িত; বিপরীতে আগের দুটি কমিশন হয়েছিল আইন ছাড়াই, কিন্তু অনুসন্ধান প্রক্রিয়া ছিল অংশগ্রহণমূলক।

বাছাই প্রক্রিয়ায় বিরোধীদের অনাস্থা ও অংশগ্রহণে অস্বীকৃতির কারণে কয়েকজন তাঁদের নাম প্রস্তাবিত তালিকায় না রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। কেননা, তাঁরা পক্ষপাতের অভিযোগে বিতর্কিত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি। নতুন কমিশনে যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন, স্পষ্টতই তাঁদের কাছে সে রকম কিছু মনে হয়নি। অন্য কমিশনাররাও যদি সিইসির মতো নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার অপরিহার্যতা সমর্থন করেন, তাহলে মানতেই হবে, তাঁরা সবাই ঘোড়ার আগে জুড়ে দেওয়া গাড়িতে সওয়ার হয়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে নির্বাচন কমিশন কী ধরনের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে পারে, তার যে ইঙ্গিত হাবিবুল আউয়াল দিয়েছেন, বিরোধীদের উদ্বেগও সেই বিষয়ে। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নটিকেই তাঁরা প্রধান বলে গণ্য করছেন। বিরোধী দলের এই অবস্থান সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে উঠে এসেছে নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার কথায়। তাঁর কথায় অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করে যদি শেখ হাসিনাও সিইসি হন, তাহলে তিনিও তখনকার সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো নির্বাচন করতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সব সময় প্রতিপক্ষ হিসেবে যাঁরা উঠে আসেন, সেই বিএনপির নেতারা নতুন কমিশনকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করেই ক্ষান্ত হননি; তাঁরা বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং সেই সরকারের অধীনে নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। বিএনপি ও তার মিত্র ছাড়াও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মতো বামপন্থী এবং ইসলামী আন্দোলনের মতো ডানপন্থী আরও কয়েকটি দল নতুন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করে বলেছে, এই কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে। ঠিক তার উল্টো বলেছে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। এমনকি, ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী শরিক সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নতুন কমিশনকে আওয়ামী লীগের পছন্দের বলে অভিহিত করেছে। ফলে নতুন সিইসি যে রাজনৈতিক সমঝোতা আশা করছেন, তা অর্জিত না হলে তিনি কী করবেন, সে কথাও আমাদের জানা প্রয়োজন।

নতুন কমিশনের সমালোচনায় সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে বিষয়, তা হচ্ছে কমিশনে আমলাদের প্রাধান্য। আমলাদের প্রশ্নটি গুরুত্ব পাওয়ার কারণ তাঁদের কর্মজীবন কাটে প্রধানত স্বাধীনভাবে কাজ করার চেয়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালনে। যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা সবাই বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন কাজ করেছেন, পদোন্নতি পেয়েছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন। রকিব কমিশন ও হুদা কমিশন গঠনের সময়েও এই আনুগত্যের বিষয়টিই যে প্রধান বিবেচ্য ছিল, তা নিয়ে খুব একটা বিতর্কের অবকাশ নেই।

অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক দল ও নাগরিক প্রতিনিধিরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে বিষয়ের ওপর, তা ছিল কোনো সরকারের সুবিধাভোগী বা বিরাগভাজন হওয়া কাউকে যেন কমিশনের জন্য সুপারিশ করা না হয়। নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নিয়োগে ওই দাবির একেবারেই উল্টোটা ঘটেছে। প্রতিরক্ষাসচিব হিসেবে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ প্রতিরক্ষামন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে নিশ্চয়ই পরপর দুবার তাঁর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সম্ভব ছিল না? আইন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষিত হওয়া এবং দুজন বিচারকের বিধিবহির্ভূত অবসরের বিষয়ে দায় স্বীকার করে সংসদীয় কমিটির কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর প্রশাসনে তাঁর উন্নতি অব্যাহত থাকার আর কোনো ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে কি?

প্রশাসনে দলীয়করণের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য প্রধান বিবেচ্য হওয়ার অভিযোগ অনেক দিনের এবং আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিবের আধিক্যের কথাও সবারই জানা। জ্যেষ্ঠ সচিব পদে পদোন্নতি, অবসরের পর বিভিন্ন কমিশন বা আধা সরকারি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে বিশেষ সুবিধা ছাড়া আর কী বলা যায়? এই পটভূমিতে আমলাদের বাইরে নিয়োগপ্রাপ্ত একমাত্র কমিশনার হলেন সাবেক জেলা আদালতের বিচারক রাশিদা সুলতানা। তবে আমাদের নিম্ন আদালতের স্বাধীনতাও প্রশ্নাতীত নয়। রাজনৈতিক সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ বা অসহযোগিতা স্বাধীনভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো দুরূহ কিছু তাঁদের কাছে প্রত্যাশা করা কঠিন।

অনুসন্ধান কমিটি কমিশন গঠনের জন্য জমা পড়া তিন শতাধিক নামের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করলেও কে কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশের দাবি অগ্রাহ্য করেছে। ফলে একধরনের ধূম্রজাল থেকেই গেছে। এখন নানা সূত্রে জানা যাচ্ছে, কমিশনে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের নাম এসেছে ক্ষমতাসীন জোটের শরিকদের প্রস্তাবে। সমকাল জানিয়েছে, নতুন সিইসির নাম প্রস্তাব করেছেন ক্ষমতাসীন জোটের দুই শরিক তরীকত ফেডারেশন ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল। এর বাইরে এনপিপি নামের একটি দল, যারা বিএনপির সঙ্গ ছেড়ে সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, তারাও তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিল। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুদা কমিশন গঠনের সময় আওয়ামী লীগ তাদের ছোট শরিক তরীকত ফেডারেশনকে দিয়ে নিজেদের পছন্দের নাম প্রস্তাব করিয়েছিল। এবারও জোটসঙ্গীদের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করার কথা একাধিক পত্রিকায় বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা কেন কোন নাম প্রস্তাব করেছে, এর বিবরণ প্রকাশে বাধা দিয়েছে, প্রক্সি ব্যবহারের তরিকা অনুসরণে তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা মেলে।

আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করে বলেছে, এই কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে। ঠিক তার উল্টো বলেছে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। এমনকি, ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী শরিক সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নতুন কমিশনকে আওয়ামী লীগের পছন্দের বলে অভিহিত করেছে। ফলে নতুন সিইসি যে রাজনৈতিক সমঝোতা আশা করছেন, তা অর্জিত না হলে তিনি কী করবেন, সে কথাও আমাদের জানা প্রয়োজন।

Also Read: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অপরিহার্যতা ‘কবুল’ করলেন সিইসি?

মানবাধিকার প্রশ্নে র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সামাল দিতে আমরা যখন পেরেশান, তখন নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো বিপত্তি সৃষ্টির ঝুঁকি এড়ানো প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন মানবাধিকারের মতো গণতন্ত্রের প্রশ্নেও এখন নিষেধাজ্ঞার হাতিয়ার প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিরোধের সমাধান না পাওয়ায় সোমালিয়ার সরকার পার্লামেন্ট নির্বাচন করতে না পারায় ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর আগে নিকারাগুয়ার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাধা সৃষ্টির জন্য অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ–নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা বা তা ঝুলিয়ে রেখে সময়ক্ষেপণ কোনোভাবেই সমীচীন নয়।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক