বর্ষবরণ, পান্তা-ইলিশের টুইস্ট
পয়লা বৈশাখ দরজায় কড়া নাড়ছে। রাজধানীর রাজসিক নাগরিকেরা বৈশাখের পয়লা দিনটা ধুমধামে পালনের জন্য এক মহা আবিষ্কার জুড়ে দিয়েছে উদ্যাপনের উপাদান তালিকায়। গভীর জলের মাছ ঢাকায় পান্তার জলে সাঁতরায় শুধু পয়লা বৈশাখে। কার উর্বর মস্তিষ্ক ইলিশ-পান্তার অসম টুইস্ট দিনটাকে সুপারডুপার বানাবে ভেবেছিল জানা নেই। যা একত্রে কখনোই বাঙালির খাদ্যতালিকায় ছিল না তা বিনা তর্কে হয়ে উঠেছে থালা বা সানকিতে আনন্দ সম্পূর্ণ করা রোমান্টিক জুটি। এখন বৈশাখ আসার আগেই ঘ্রাণ আসে ইলিশ আর পান্তার।
মনে মনে সে দুইয়ের ঘ্রাণের সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে বৈশাখের আগমনধ্বনি। ঢাকের বাদ্য বেজে চলেছে। প্রায় রোজই আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয় প্রাণে প্রাণে। শিগগিরই আসছে পয়লা বৈশাখ। সাজসাজ রব চারদিকে। এটা পরব ওটা দিয়ে সাজব, বের হব পথে। ঘুরে বেড়ানো হবে ইচ্ছেমতো। যাব যেখানে খুশি সেখানে। হুলুস্থুলে কাটবে সারাটা দিন।
দিনের শেষে সেসব হুলুস্থুলের ছবি সবাই দেখবে টেলিভিশনে। দেখব চারদিকে কত রকম আনন্দ ছিল, শত রঙের সহস্র আয়োজনের ছবি পরের দিন খবরের কাগজেও দেখা যাবে। খবরের কাগজে উদ্যাপনের ছবি মানে দিনটা গত হয়ে গেছে, উঠে গেছে স্মৃতিতালিকায়। তখন বলতে হবে পয়লা বৈশাখ এসেছিল। মনে করব, একে ওকে বলব, আমরা এই করেছিলাম, সেই করেছিলাম। এই আর সেই করার আনন্দ ফুরিয়ে যায়, আমরা ফুরাই না। অন্য কোনো দিন, অন্য কোনো উদ্যাপনের জন্য অপেক্ষা করতে লেগে যাই। আমাদের ইলিশ-পান্তার সুখ শুকনো পাতার সঙ্গে বটতলায় পড়ে থাকে। আনন্দ-উত্তেজনার গুঁড়ো কোথায় উড়ে চলে যায়, খোঁজ নেওয়া হয় না। লিচুতলা থেকে রাঙানো গাল অগোচরে কখন যেন হয়ে যায় রংহীন। কীভাবে কোন পথে, কোন চলায় হারিয়ে যায়। সময়ের স্বভাবই এ রকম। জোয়ারের মতো হই হই করে সব বয়ে আনে আবার ভাটার টানে সবই বয়ে নিয়ে চলে যায়। নিয়ে যেতে পারে না স্মৃতি। সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো তা আমাদের কাছে রয়ে যায়, আমরা নেড়েচেড়ে দেখি, দেখে সুখ পাই। সময় গড়িয়ে গেলে সান্ত্বনা পুরস্কারটাও আর নেড়েচেড়ে দেখার তাগিদ জাগে না। তাগিদেও আছে জোয়ার, রয়েছে ভাটা।
পয়লা বৈশাখে সবাই আনন্দ করি, কেন করি? এমন প্রশ্ন কেউ করলে তাকে আস্ত গাধা মনে হবে। সবাই আনন্দ করে, দিনটা বছরের প্রথম তাই। বছরের পয়লা দিনটা এভাবে না কাটালে সারা বছরটা যদি যাচ্ছেতাই রকমে কাটে! এমন উত্কণ্ঠা বোধ হয় থাকে মনে। আমাদের মনে আছে উৎসাহ, অশেষ আনন্দ। উদ্যাপনের আগ্রহও কম নেই, তাই অকুণ্ঠ চিত্তে অজস্রে মিলে বর্ষবরণ করি। বর্ষবরণ মানে নতুনকে বরণ। পুরোনো যা কিছু, পড়ে থাকুক পেছনে। বর্ষবরণ মানে নতুনকে সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। নতুন চাওয়া, নতুন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জীবন পেতে পারে নতুনত্বের স্বাদ। এ রকম ভাবনা থাকে মনে মনে। ভাবনা থাকে, থাকে প্রবল অশ্বশক্তির আশা। আমরা সাঁতরানোর কষ্ট করব না, আশা আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সুখসাগরে এমন আলসে মনোবাসনাও থাকে। থাকে না কর্তব্য, থাকে না দায়।
উদ্যাপন আমাদের ভালো লাগে, ভালো লাগে উদ্যাপনের উপলক্ষে। একা, দুজনে অথবা দল বেঁধে আনন্দের পথে বেরিয়ে পড়া হয়। গোমড়ামুখোরাও থাকি না গোমড়ামুখে। বেদনার বিষয় হলো, পয়লা বৈশাখকে আমরা বোধ হয় শুধু উদ্যাপন ও আনন্দ লাভের একটা দিন হিসেবে দেখি। তার বেশি কে কতটা ভাবি, ভাবা উচিত বলে মনে করি? পয়লা বৈশাখ একটা বার্তা নিয়েই আসে। আসে জাগিয়ে দিতে। আমরা উৎসবের জন্য উদ্দীপনায় জাগি। দিনটা পার হয়ে গেলে যেমন ছিলাম তেমনই ফিরে যাই। এমন তো হওয়ার কথা নয়। পয়লা বৈশাখ পুরোনো হিসাব গুটিয়ে নতুন করে আর এক শুরুর কথা বলে। পুরোনো ভুলভ্রান্তি, দুঃখ-শোকের ইতি টেনে নতুনের আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত হতে বলে। পাওয়া না-পাওয়ার আনন্দ, হতাশা ভুলে নতুন আশায় বুক বাঁধতে বলে। সোজা কথায়, পুরোনো যে আমি ছিলাম তার বদলে নতুন বছরে হব নতুন এক আমি, এমন আশা থাকে না বলে তা হওয়া হয় না আমাদের। যা ছিলাম প্রত্যেকে তা-ই রয়ে যাই। শুধু এক দিনের জন্য নতুন কাপড়ে নতুন বাহারে দিনটাকে উপভোগের ইচ্ছায় বেরিয়ে পড়ি ঘর থেকে পথে। দিন গেলে হাতে কী থাকে? ভেবে দেখি না কেউ, নতুন এসেছিল আমরা নতুন সেজে উদ্যাপন শেষে রয়ে যাই যার যার মতো সেই পুরোনোতেই।
নিজেদের নিয়ে হিসাবে বসি কতজন? কতজনে গত বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা, দোষ-গুণ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কারণগুলো নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার মনে করি? কতজন আগের ভুল স্বীকার করি, সে ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করি, শোধরাব বলে অঙ্গীকার করি? কতজন ভাবি, নিজের সামান্য বদলে সমাজ, সংসারে অল্প বা বড়সড় পরিবর্তন আসতে পারে। প্রত্যেকের মধ্যে ভালোর পাশাপাশি মন্দ থাকে খানিকটা, সেসবকে চিহ্নিত করতে পারা বড় যোগ্যতা। নিজেদের মন্দ আবিষ্কার বা স্বীকারের সৎসাহস কি রয়েছে আমাদের? আমরা অন্যের মন্দ ভাবা বা বলায় সদা এক পায়ে খাড়া থাকি তা নতুন করে বলতে হবে না। অমুকে ভালো নেই, এটা ভাবা আনন্দের। অমুকে ভালো নয় সেটা ভাবা আরও আনন্দের। যাতে আমরা সুখ পাই তা যে অসুখ, ভেবে দেখা হয় না। হয় না বলে বদলের প্রশ্ন আসে না। থেকে যাই যেমন ছিলাম তেমনই।
নতুন বছর আসে, নতুন একটা জীবনের জন্য নিজের কী দায় বা কর্তব্য রয়েছে, ভেবে কি দেখা হয়? আমরা চাই অনেক কিছু। চাই, যা আমাদের পাওয়া হয়নি। কেন পাওয়া হয়নি সে হিসাব বা অঙ্কে বসা হয় না। নিজের অসম্পূর্ণতা, দুর্বলতায় অনেক কিছু পাওয়া হয়নি জানলে সে দুর্বলতা কাটিয়ে সবল ও সফল হওয়া সম্ভব। জীবন হাপিত্যেশের নয়। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি উভয়ের মিশেলেই জীবন মধুর, আকর্ষণীয়। আঁধারের অস্তিত্ব না থাকলে আলোকে বোঝা হতো না, তেমনি না পাওয়া আছে বলে পাওয়ার আনন্দকে মন ভরে বুঝতে পারি।
জগৎ ছায়ার, আলোর। জগৎ ভালো এবং কালোরও। এ জগৎ সুখ ও দুঃখের, আশা-হতাশার, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির। অসংখ্য স্বাভাবিকের সঙ্গে অজস্র অস্বাভাবিকতাও রয়েছে জগতে। বাণিজ্যে যেমন এটা কিনলে ওটা ফ্রি রয়েছে, জীবনেও তেমন পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয়। সুখ কিনতে হলে সঙ্গে দুঃখ ফ্রি। শুধু ভালোটাই জুটবে এমন প্যাকেজ ডিল মানুষকে দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়নি বোধ হয় ভালো রাখার জন্যই। ভালো থাকা বা না থাকা সবটা মানুষের হাতে নেই। আবার এ কথাও ঠিক, মানুষ চাইলে ভালো থাকার উপায় বের করে নিতে পারে। সে সামর্থ্য মানুষের আছে। কৌতুককর নিয়ম হচ্ছে, সচেতনতা না থাকলে সামর্থ্য কাজে আসবে না। ভাগ্যে যখন ভালোর বদলে মন্দ ঘটে, নিজের আগে আশপাশের সবকিছুর ওপর দোষ চাপাতে ভালোবাসে মানুষ। সেখানেই শেষ হয়ে যায় না, মন্দের জন্য মানুষ নির্দ্বিধায় কপালকে দায়ী করে। এমনকি সৃষ্টিকর্তাকেও দায়ী করে ফেলে চোখের পলকে।
আত্মসমালোচনা, আত্মসংযমের শক্তি মানুষের মধ্যে আছে এবং নেইও। ভালোকে ভালোবাসলেও মন্দ চর্চায় আমাদের আকর্ষণ, আগ্রহ দুই-ই বেশি। সবাই স্বাধীনতাপ্রিয় তবে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার অধিকতর পছন্দের। ন্যায়নীতি প্রসঙ্গে দারুণ উৎসাহ, তা নিয়ে গরমাগরম কথা বলাবলি খুবই পছন্দের হলেও স্বার্থের বিবেচনায় সেসব ভেঙে চুরমার করে দিতে দ্বিধাহীন। সব আছে মানুষের। অমনোযোগ আর অসচেতনতা আছে বলেই অনেক কিছু থেকেও নেই। যথেষ্ট বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ভূরি ভূরি বোকামির উদাহরণ চোখে দেখা যায়। দোষত্রুটি ভালো করেই চেনে, জানে শুদ্ধ হওয়ার উপায় কিন্তু শুদ্ধ হওয়ার অনুশীলনে উৎসাহ কম। ব্যাপক উৎসাহ পরার্মশদানে, কিন্তু শোনার বেলায় প্রায় সবাই আগ্রহহীন।
সময় আমাদের এ বয়স থেকে সে বয়সে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আমাদের চেহারায় বদল আসে, পরিচয়ে আসে পরিবর্তন কিন্তু স্বভাব খুব বেশি বদলায় না। নতুন বছর আসে যায়। তার আসার আকাঙ্ক্ষায় থাকি, যাওয়ার বেদনাতেও ভুগি। মন খুলে বর্ষবরণে নেমে পড়া হয়, নতুন জীবনকে বরণ করা হয়ে ওঠে না। নতুন বছর আসুক। বছরের যাবতীয় আবর্জনা উড়িয়ে নিয়ে চলে যাক, তারপর আবর্জনাহীনতা কি নতুন সৌন্দর্য নিয়ে বাঁচার কথা বলবে না? একই জীবন, একই ভুল, একই হতাশা, একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন আর এক শুরুর কী ফল লাভ হবে?
আনন্দ করি, উদ্যাপনে মাতি তারপর নিজের ভেতর নতুন আরেক মানুষকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করি। নতুন চেতনাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করি। নতুন বছর নতুন কিছু এনে দেবে, জীবনে আশা করেই ক্ষান্ত না হই। পান্তা-ইলিশের টুইস্টে যেমন দশাই হোক, বেরিয়ে আসি, দাঁড়াই। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়া দরকার। বোঝাপড়ার মাধ্যমে কী ফল লাভ হতে পারে, তারও একটা আগাম ভাবনা দরকার। শুধু ভাবনায় তার ইতি নয়, তাকে সার্থক করার জন্য একটা প্রতিজ্ঞা দরকার। প্রতিজ্ঞা করি, সবাই ভালো থাকব, ভালো রাখব।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক, নির্দেশক।
afzalhossain1515@yahoo.com
আরও পড়ুন
-
যুক্তরাষ্ট্রে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছেলের মৃত্যু, কান্না থামছে না মা–বাবার
-
সাকিবের সঙ্গে দেখা করলেন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী, মুহূর্তেই ছবি ভাইরাল
-
রাজধানীর তাপমাত্রা আরও বাড়ল, চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ
-
মোস্তাফিজের এবারের আইপিএল: সাবেক দলের বিপক্ষে উইকেট যে কারণে কম
-
ট্রাম্পের বয়স নিয়ে খোঁচা দিলেন জো বাইডেন