Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশকে পা ফেলতে হবে সাবধানে

দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) গণচীনের সাম্প্রতিক সাড়া জাগানো আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তোলার উদ্যোগ, যার মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ওশেনিয়ার ৬০টি দেশের যোগাযোগব্যবস্থা, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্পায়নে গণচীনের প্রভূত বিনিয়োগ অর্থায়ন সহযোগিতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং বিস্তৃত পরিসরে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। 

এটাকে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবর)ও বলা হয়, যেটার মধ্যে একটি মাত্রা হলো স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর মহাসড়ক, রেল যোগাযোগ ও বিমান যোগাযোগ উন্নয়নের মাধ্যমে ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ গড়ে তোলা আর অপরটি হলো সমুদ্রতীরবর্তী দেশগুলোতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে ‘একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রোড’ উন্নয়ন। বিআরআই প্রকৃত পক্ষে এসব দেশের ভৌত অবকাঠামোর ঘাটতি পূরণের একটি অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, যেটা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের প্রভাব ক্ষুণ্ন করে ওগুলোর সরাসরি বিকল্প হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে বলা চলে। এর আগে গণচীন ২০১৪ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার যৌথ মালিকানায় এসব দেশের ইংরেজি নামের আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত ব্রিকস (BRICS) ব্যাংক স্থাপন করে, কিন্তু ওই ব্যাংকটি রহস্যজনকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আসতে পারেনি। এরপর গণচীন আরও বিস্তৃত পরিসরে ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশও অংশীদার হিসেবে অংশ নিয়েছে। এআইআইবির সাংগঠনিক কাঠামো ইতিমধ্যেই দাঁড়িয়ে গেছে এবং এই ব্যাংক থেকে বিভিন্ন দেশের ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন জোরেশোরে শুরু হয়ে গেছে। 

এতত্সত্ত্বেও যখন ২০১৬ সালে গণচীন অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) গ্রহণের ঘোষণা দিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারত এই উদ্যোগকে বিশ্বব্যাপী চীনের আধিপত্য বিস্তারের প্রত্যক্ষ প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে। এই তিন পরাশক্তি রাখঢাক না করেই চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তাদের মিত্রদেশগুলো বিআরআই উদ্যোগে শামিল না হয়। অপরদিকে রাশিয়া ও ইতালি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এটি এখন বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের পাশা খেলায় পরিণত হয়েছে বলা চলে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্টের’ অধীনে ছয়টি স্থল-করিডর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে:

১. দ্য নিউ ইউরোশিয়ান ল্যান্ডব্রিজ গড়ে তোলা হবে চীনের জিনজিয়াং থেকে রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চল হয়ে কাজাখস্তানের মধ্য দিয়ে বেলারুশ, পোল্যান্ড ও জার্মানি পর্যন্ত ‘সিল্করুট রেলওয়ে’ নির্মাণ; ২. চীন-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া করিডর রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সমুদ্রবন্দর ভ্লাডিভোস্টক পর্যন্ত প্রসারিত হবে; ৩. চীন-মধ্য এশিয়া-পশ্চিম এশিয়া করিডর চীনকে তুরস্কের সঙ্গে রেলপথে ও সড়কপথে যুক্ত করার ব্যবস্থা; ৪. চীন-ইন্দোচীন উপদ্বীপ করিডর চীনকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে মহাসড়ক ও রেলপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে; ৫. বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং নগরীর সঙ্গে রেলপথে ও মহাসড়কের মাধ্যমে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত করিডর; এবং ৬. চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর চীনের পশ্চিমাঞ্চলকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গোয়াদর গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে রেলপথে ও সড়কপথে সংযুক্ত করবে। 

এই ছয়টি করিডর গড়ে তোলার কাজ কয়েক বছর আগেই শুরু করা হয়েছে এবং এগুলোকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ ঘোষণার আগে বেশ কয়েকটির নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে বিআরআই ঘোষণার এক দশক আগেই বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর বা ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছিল। ভারতের তদানীন্তন কংগ্রেস সরকার বিসিআইএম ইকোনমিক করিডরের কার্যক্রমে এক দশক ধরে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার বিসিআইএম চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ করে দেয়। ফলে এখন ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’ জীবন্মৃত অবস্থায় ঝুলে গেছে, বাংলাদেশ এখন এ ব্যাপারে ভারতের মোদি সরকারের চাপের মুখে। ২০১৪ সালে ভারতের কারণেই কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনকে অর্থায়ন করার আমন্ত্রণ জানিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বাতিল করেছিল। এখন নাকি ওখানে একটি ‘ইকো-টু্যরিজম পার্ক’ গড়ে তোলা হবে। 

২০১৬ সালে বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই বছর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় চীন বাংলাদেশকে ২১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ঋণ প্রদানের অঙ্গীকারনামায়ও স্বাক্ষর করেছে, যদিও গত তিন বছরে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়ে এখনো কাগুজে দলিলেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় আরও কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর চুক্তি যেহেতু ‘ঠান্ডা ঘরে’ নির্বাসিত হয়ে থাকলেও এ ব্যাপারে আগ্রহের যে কমতি নেই, হয়তো সে মেসেজটা বাংলাদেশ চীনকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মোদি সরকারের আমলের ভারত যেহেতু প্রতিবেশীদের সঙ্গে আঞ্চলিক সুপারপাওয়ারের ভূমিকা পালন করতে বদ্ধপরিকর, তাই ভারতকে এই ইস্যুতে সমীহ করতে হবে আমাদের। ভারত যেহেতু বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে বেষ্টন করে রয়েছে, তাই বাংলাদেশ যদি ভারতকে অগ্রাহ্য করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বেশি আগ্রহ দেখায়, তাহলে ভারত বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে চাইবে। 

সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ভারত সফরের সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভারতে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী থাকার ইস্যুতে যেভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে, তাতে ভারতের এহেন ‘দাদাগিরি’ শুরু হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা হচ্ছে। কোনো যুক্ত বিবৃতি ছাড়া দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক সমাপ্ত হওয়াকে অশনিসংকেত মনে হচ্ছে। ভারত ভবিষ্যতে আরও বৈরী পদক্ষেপ নিতে পারে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলার উদ্দেশ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানও যেহেতু এই ভূ-রাজনৈতিক খেলায় ভারতের দোসর, সে জন্য বাংলাদেশকে খুবই সাবধানে পা ফেলতে হবে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর ব্যাপারে।

সাম্প্রতিক খবর হলো, বিকল্প গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে এখন সোনাদিয়া দ্বীপের কিছুটা দূরে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে জাপানের সহায়তায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় কি না, তার সম্ভাব্যতা জরিপ কাজ এগিয়ে চলেছে। অথচ অনেকেই হয়তো জানেন না যে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলার ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ জাপানের অর্থায়নে জাপানের একটি ফার্মের মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হয়েছিল ২০০৯ সালে। ওই স্টাডি মোতাবেক জাপানই বলেছিল, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য সোনাদিয়া উত্তম স্থান হবে, কারণ সোনাদিয়ার অদূরে স্থলভাগ পর্যন্ত ১৫ মিটারের (মানে প্রায় ৫০ ফুটের) বেশি গভীর বঙ্গোপসাগরের একটি স্বাভাবিক খাঁড়ি রয়েছে। এই স্টাডি মোতাবেক ওই অঞ্চলের সমুদ্র-তলদেশও নাকি খুবই স্থিতিশীল। ওই খাঁড়ির কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে নাকি বন্দরের গভীরতা বজায় রাখার জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিং দরকার হবে না। 

চীনকে বঙ্গোপসাগরে সহজ প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ ভারত, সে জন্যই ভন্ডুল হয়ে গিয়েছে চীনের অর্থায়নে সোনাদিয়া বন্দর নির্মাণ প্রকল্প। কিন্তু বাংলাদেশের একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এখন ফরজ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম বন্দর একটি ‘লাইটারেজ পোর্টে’ পরিণত হওয়ায়। তাই আমি মনে করি সোনাদিয়ার ব্যাপারে কোমর সোজা করে দাঁড়ানোই বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক হবে। চীনকে বাদ দিয়েও সোনাদিয়া প্রকল্পের বিকল্প অর্থায়ন-সূত্র খুঁজে পেতে বাংলাদেশের তেমন অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।

ড. মইনুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়