Thank you for trying Sticky AMP!!

বাংলাদেশ কি তুর্কি সমরাস্ত্র কিনতে পারবে?

সংবাদ সম্মেলনে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত সাভাসগলু ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন

তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুশোওলুর ঢাকা সফর নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা ছিল। ঢাকা বা আঙ্কারা কোনো পক্ষই সফরের আলোচ্যসূচি নিয়ে খুব বেশি খোলাসা করে কিছু বলেনি। অনেকেই মনে করেছিলেন, আর দশটা কূটনৈতিক সফরের মতোই কিছু দ্বিপক্ষীয় ও বাণিজ্যিক বিষয়ের পাশাপাশি সৌহার্দ্য বিনিময় নিয়ে আলোচনা হবে। এর বড় অংশজুড়ে থাকবে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের আলাপ। বড়জোর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তুরস্ক সরকার নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে পারে।

কিন্তু গত বুধবার দুপুরে ঢাকায় সাংবাদিকদের বিফ্রিং করার সময় চাভুশোওলু সবাইকে চমকে দিয়েছেন। লুকোছাপা না করেই বলেছেন, তুরস্ক নিজের তৈরি সমরাস্ত্র বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করতে চায় এবং বাংলাদেশে সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী।

তুরস্কের কাছ থেকে এমন প্রস্তাবের জন্য অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন না। হয়তোবা দুই দেশের কূটনৈতিক মহলে এ নিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে আলাপ–আলোচনা ছিল। কিন্তু অন্যদের কাছে তুরস্কের সমরাস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এ রকম কিছু বিষয় আলোচনা হবে, কেউ কেউ জানতে পারলে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের মতোই চাভুশোওলুর সফর বাতিল হতে পারত। তুরস্ক দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের পদচিহ্ন রাখতে চাইছে। পাকিস্তানের কাছে সমরাস্ত্র অনেক দিন ধরেই বিক্রি করছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানেও বিক্রি শুরু করেছে। এখন বাংলাদেশকেও সমরাস্ত্রের খদ্দের বানাতে চাইছে।

তুর্কি সমরাস্ত্রের দাম যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় কম। মূলত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো স্বল্প দামে সমরাস্ত্র সরবরাহ করে। চীনও স্বল্প মূল্যের সমরাস্ত্রের ব্যবসা করে। অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে তুরস্কের বেশি নামডাক ছিল না। কিন্তু বিশ্ববাজারে স্বল্প দামের অস্ত্র বিক্রি করে তুরস্ক এক ঢিলে অনেক পাখি শিকার করতে চাইছে।

প্রথমত মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে স্বল্প দামে অস্ত্র রপ্তানি করে নিজের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও প্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করা। অস্ত্রের আরও নতুন নতুন বাজার খুঁজছে। অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনার ধাক্কার মুখে চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় তুরস্কের অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি সামরিক শিল্পের রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে গত এক দশকে তুরস্কের সামরিক শিল্প অনেকটাই এগিয়েছে। ২০২৩ সাল নাগাদ সামরিক খাত থেকে ২৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

২০১৭ সালে তুরস্ক সামরিক খাত থেকে আয় করেছিল ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। দেশটি তার সামরিক সরঞ্জামের ৬৫ শতাংশ নিজেই উৎপাদন করে। ২০২৩ সাল নাগাদ ৭৫ শতাংশ করতে চাইছে। এভাবে দেশটি অস্ত্র আমদানিকারক থেকে রপ্তানিকারী দেশে পরিণত হচ্ছে তুরস্ক। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, পাকিস্তান, আজারবাইজান ও তুর্কমিনিস্তান তুর্কি সামরিক সরঞ্জামের বড় ক্রেতা।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি হোক বা না হোক, আগামী কিছুদিন বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের ব্যস্ত সময় যাবে। এ সময় পাল্টাপাল্টি প্রস্তাবের কূটনৈতিক খেলা শুরু হতে পারে। তাই বাংলাদেশকে হিসাব কষে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

তুরস্ক ড্রোন, রকেট লাঞ্চার, স্বল্প পাল্লার মিসাইল, সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও ট্যাংক ইত্যাদি উৎপাদন করছে। তাদের টি-১২৯ হেলিকপ্টার একসঙ্গে আটটি অ্যান্টিট্যাংক মিসাইল, ১২টি নিয়ন্ত্রিত নিক্ষেপণযোগ্য রকেট ও অটোমেটিক গানের জন্য ৫০০টি গুলি বহন করতে পারে। এই হেলিকপ্টার প্রচণ্ড গরম ও ঠান্ডায় বিরূপ পরিবেশে রাতের আঁধার বা দিনের আলোতে ভূমি থেকে অনেক উচ্চতায় অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম। টি-১৫৫ ফিরটিনা মিসাইল ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

সম্প্রতি তুর্কি সমরাস্ত্রের বড় ধরনের ব্যবহার হয়েছে সিরিয়া ও নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে। তুরস্ক সিরিয়ার যুদ্ধে অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চে কুর্দিদের বিরুদ্ধে নিজস্ব সমরাস্ত্র ব্যবহার করে সফল হয়েছে। নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে আজারবাইজান তুরস্কের সরবরাহ করা ড্রোন ব্যবহার করে ফরাসি সহায়তাপুষ্ট আর্মেনিয়াকে পরাজিত করেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে। তুরস্ক মূলত সামরিক ড্রোন, রকেট লাঞ্চার, মিসাইল, হেলিকপ্টার, সাঁজোয়া যান, যুদ্ধজাহাজ ও ট্যাংক বিক্রি করতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কি তুরস্কের থেকে শেষ পর্যন্ত সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারবে? এটা কেবলই অস্ত্র ক্রয়–বিক্রয়ের বিষয় নয়। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি হিসাব–নিকাশ জড়িত। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচ্য হবে।

একটি হচ্ছে প্রতিবেশী ও বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়া। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে তুরস্কের অস্ত্র কেনা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না। ওই দুটি দেশ থেকে বাধা আসতে পারে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, পাকিস্তান দেড় বিলিয়ন ডলারে ৩০টি তুর্কি টি-১২৯ অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার জন্য ২০১৮ সালে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হেলিকপ্টার বিক্রিতে তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারণ, এই হেলিকপ্টারে ব্যবহৃত ইঞ্জিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি; তুরস্ক এসব ইঞ্জিনচালিত হেলিকপ্টার যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে না। এখন তুরস্ক নিজেই ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা করছে। পাকিস্তান নিজেও যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছে। ২০২০ সালেই হেলিকপ্টারগুলো হস্তান্তরের কথা ছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০২১ সাল পর্যন্ত হস্তান্তরের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাকিস্তানের তুর্কি সমরাস্ত্র কেনা আটকে দিয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা ঘটতে পারে। তা ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত চাইবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগদান করুক। বিশেষ করে ভারত চাইবে না তার দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে সামরিক খাতে আরও শক্তিশালী হতে তুরস্ক সহায়তা করুক। ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তার জটিল বিষয়গুলো এখানে সব পক্ষই বিবেচনা করবে। বাংলাদেশে অস্ত্র বিক্রি বা উৎপাদনের নামে ভারত মহাসাগর এলাকায় তুরস্কের উপস্থিতি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রেও জন্য সুখকর হবে না। এই অঞ্চলে তুরস্কের আনাগোনা বাড়লে রাশিয়া ও চীনের সুবিধা হবে। সিরিয়ার মতোই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্ক মিলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ তুরস্কের সঙ্গে দর-কষাকষি কতটুকু করতে পারবে। চাভুশোওলুর সফরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। তুরস্ক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্মাণ প্রকল্প ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কামাল আতাতুর্কের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করার প্রস্তাব রয়েছে। এসব প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে সমরাস্ত্র কেনার আলোচনার অগ্রগতির ওপর। চাভুশোওলুর সফরের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অস্ত্র বিক্রি করা; বাকিগুলো উপলক্ষ মাত্র।

তুরস্ক কিছুদিন ধরেই নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম দেশকে নিজেদের পক্ষভুক্ত করতে চাইবে। পক্ষভুক্ত করার সহজ পন্থা হচ্ছে সামরিক ও অর্থনৈতিক খাতে নির্ভরশীল করা। তুরস্ক সেই পরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বে এখন সৌদি আরব, ইরান ও তুরস্ক— এই তিন ধারা সক্রিয় আছে। সৌদি আরব ইস্যুতে ইরান ও তুরস্ক একই অক্ষে অবস্থান করলেও উভয় দেশই নিজেকে নেতৃত্বে দেখতে চায়। তাই সৌদি আরব ও ইরানের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশের ওপর চাপ আসতে পারে। তবে চীনের দিক থেকে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া নাও আসতে পারে।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে তুরস্কের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি হোক বা না হোক, আগামী কিছুদিন বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের ব্যস্ত সময় যাবে। এ সময় পাল্টাপাল্টি প্রস্তাবের কূটনৈতিক খেলা শুরু হতে পারে। তাই বাংলাদেশকে হিসাব কষে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে হবে। তবেই কূটনৈতিক দক্ষতা প্রমাণিত হবে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক