Thank you for trying Sticky AMP!!

বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাসের এখনই সময়

আমদানি-রপ্তানি তথা আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্য বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এর হিস্যা এখন প্রায় ৪১ শতাংশ। আগামী দিনগুলোতে এটি আরও বাড়বে। তবে বিশ্ববাণিজ্যের জগতে বেড়ে চলা জটিলতা মোকাবিলায় বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত হয়েছে বা হচ্ছে, সেই প্রশ্নও এখন বড় আকারে সামনে আসছে। বিশেষ করে গত বছর বিশ্ববাণিজ্য নানা ধরনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি ও কৌশলে তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংশোধনের আভাস মেলেনি।

অথচ বাণিজ্যনীতি একটি গতিশীল বিষয়। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এর পরিবর্তন বা পুনর্বিন্যাসও একটি স্বাভাবিক কাজ। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে এমন নিয়মকানুন ও রীতিনীতিসমূহের একটি সমন্বিত রূপ হলো বাণিজ্যনীতি। বাণিজ্যনীতি যত স্পষ্ট হয়, ততই তা ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য সহায়ক হয়। কোনো কোনো দেশে, বিশেষত উন্নত দেশে বাণিজ্যনীতির একটি সুসংহত ও সুলিখিত রূপ থাকে, উন্নয়নশীল দেশের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই তা থাকে না। আবার বাংলাদেশসহ কোনো কোনো দেশে আমদানি ও রপ্তানিনীতিসমূহ আলাদা আলাদাভাবে লিখিত ও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমন্বিত আমদানি-রপ্তানিনীতি পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ১০ বছর আগে এ রকম একটা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। বর্তমানে চলমান তিন বছর মেয়াদি (২০১৫-১৮) রপ্তানি ও আমদানিনীতিসমূহের মেয়াদ এ বছরের ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। তবে নতুন নীতি কার্যকর না করা পর্যন্ত এগুলো বহাল থাকবে।

গেল বছর বিশ্ববাণিজ্যে প্রথম বড় ধাক্কা এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এটা অবশ্য অপ্রত্যাশিত ছিল না। তা ছাড়া প্রেসিডেন্টের যে ট্রেড পলিসি অ্যাজেন্ডা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়, তাতে স্পষ্ট ভাষাতেই বলা হয় যে তাঁদের বাণিজ্যনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো সব আমেরিকানের জন্য অধিকতর মুক্ত ও অধিকতর ন্যায্যভাবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা। সে জন্য বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতার বদলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হবে। নানা বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য আজকের যে অবস্থানে এসেছে, তা অকার্যকর করে দিতে নিজের ইচ্ছার কথা গোপন করেননি ট্রাম্প। আর তাই বছর শেষে যখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, সেখানেও আমেরিকার আপত্তিতে কোনো অগ্রগতি হলো না। মাঝখান থেকে বিষয়ভিত্তিক কয়েক পক্ষীয় বাণিজ্য সমঝোতার দ্বার প্রশস্ত করা হলো। এ ছাড়া গত বছরের মাঝামাঝিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও (ব্রেক্সিট) আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটের ক্ষেত্রে একটি ধাক্কা। স্পষ্টতই চলতি বছর ও আগামী দিনগুলোয় বিশ্ববাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি বহুলাংশে এসব ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হবে। বৈশ্বিক থেকে আঞ্চলিক-সব পর্যায়ে বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন হিসাব-নিকাশ দেখা দেবে।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি ও কৌশল পুনর্বিন্যাস করার সময় এখন চলে এসেছে। কাজটি সরকারের, বিশেষত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলেও দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এখানে সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। কেননা, তাঁরাই আমদানি-রপ্তানি করেন, ব্যবসা করেন। সরকার মূলত এখানে সহায়তাকারী।

কিন্তু ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের দিক থেকে বাণিজ্যনীতি সার্বিকভাবে পুনর্বিন্যাসের জোর কোনো দাবি ওঠেনি। এর একটা কারণ হলো, তাঁরা সাধারণত সময়ে সময়ে বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও করবিষয়ক পদক্ষেপেই সন্তুষ্ট থাকেন। বিশেষত বার্ষিক বাজেটের সময়ই তাঁরা সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট হয়ে ওঠেন বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য। এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে সরকারের রাজস্বনীতি নির্ধারণ ও সংশোধনে বাণিজ্যনীতি একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। সে জন্য বাণিজ্যনীতিতে জোর দেওয়া প্রয়োজন।

বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রধান ও সম্ভাবনাময় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (বিএফটিএ) সম্পন্ন করার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো বিএফটিএ করেনি বা করতে পারেনি। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গত বছরই বিএফটিএ করার বিষয়টি জোর দিয়ে ঘোষণার পরও কোনো অগ্রগতি নেই। আর কয়েক বছর ধরে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ভুটান, নাইজেরিয়া, মেসিডোনিয়া, মিয়ানমার, মালি ও মরিশাসের সঙ্গে বিএফটিএ করা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এসব দেশের বেশির ভাগের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য খুব কম। একসময় ভারত, তারপর চীনের সঙ্গে বিএফটিএ করার কথা জোরেশোরে উচ্চারিত হলেও এখন তা চাপা পড়ে গেছে।

আসলে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে গেলে বাণিজ্য অংশীদারদের যে ছাড় দিতে হয়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা তার জন্য অতটা প্রস্তুত নন। বিষয়টি এ রকম হয়ে গেছে যে বাংলাদেশ অবাধে পণ্য রপ্তানি করবে, কিন্তু অবাধে আমদানি করবে না। অথচ মুক্ত বাণিজ্যে তা হয় না। তা ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এত দিন যেসব বাজারসুবিধা পেয়ে এসেছে, এই কাতার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর তা একইভাবে অব্যাহত থাকবে না। এ বছরের মার্চেই এলডিসি থেকে উত্তরণবিষয়ক একটি ঘোষণা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আসতে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে গিয়ে বাংলাদেশ পুরোদস্তুর এলডিসি-বহির্ভূত উন্নয়নশীল দেশ হবে। ফলে প্রধান বাণিজ্য অংশীদারসহ সম্ভাবনাময় অংশীদারদের বাজারে রপ্তানি বাড়ানো এবং কম ব্যয়ে পণ্য আমদানির সুবিধা পেতে এখন থেকেই কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি।

আবার বিশ্ববাণিজ্যে পণ্যের মান ও মেধাস্বত্বের মতো বিষয়গুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। সম্ভাবনাময় বাজারে পণ্যের উচ্চতর ও জটিল মান অনেক ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে উঠছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে এই বাধা কাটানোর প্রধান উপায় হলো এসব মানোপযোগী পণ্য প্রস্তুত করা। শুধু অশুল্ক বাধার দোহাই পেড়ে কোনো কাজ হবে না। আবার বাংলাদেশ থেকে এখনো বৈশ্বিক মেধাস্বত্ব-ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে একযোগে একাধিক বা অনেকগুলো দেশে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের জন্য আবেদন করা যায় না। এটি পণ্যের মানোন্নয়নে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী কুশলতার পথে অন্তরায়। তাই বিশ্ব মেধাস্বত্ব সংস্থার (ডব্লিউআইপিও) তিনটি চুক্তিতে (ট্রেডমার্কের জন্য মাদ্রিদ চুক্তি, শিল্প নকশার জন্য হেগ চুক্তি এবং পেটেন্ট সহযোগিতা চুক্তি) স্বাক্ষর করার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।

ইদানীং দেশের কয়েকটি বাণিজ্য সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলে ট্রেড পলিসি অ্যাডভোকেসি বা বাণিজ্যনীতি-বিষয়ক প্রচারণার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য তারা কিছু বৃহত্তর বিষয় নির্ধারণ করেছে, যার মধ্যে আছে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি বিনিয়োগ, কর ও শুল্কনীতি, সমন্বিত আমদানি-রপ্তানিনীতি ইত্যাদি। এসব বিষয়ে কিছু বিশ্লেষণমূলক প্রচারপত্র তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে দেশের বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাসের আহ্বান জানানো হবে, আগামী দিনগুলোর জন্য এই নীতিতে কী কী গুরুত্ব পেতে পারে, সে বিষয়ে তাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হবে। এই প্রয়াস হয়তো বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাসের কাজটিকে ত্বরান্বিত করায় সহায়ক হবে।

আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক
asjadulk@gmail.com