Thank you for trying Sticky AMP!!

বাবুল, ফজলু এবং আরও কিছু খরচযোগ্য জীবন

.

ইটভাটতে কিছু ইট বেশি পুড়ে বিকৃত ও কালচে হয়ে যায়। একে বলে ঝামা ইট। এই ইট কোনো কাজে লাগে না। ২৫ বছর বিনা বিচারে বন্দী থেকে জীবন ঝামা হয়ে গেল বাবুলের, তার কী হবে? জীবন অনেক সময় কাহিনির চেয়েও করুণ ও কঠিন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ‘আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’
বহু বছর আগে কলকাতার চলচ্চিত্র সবার উপরের মূল চরিত্র বিনা অপরাধে ১২ বছর জেল খেটে বের হয়ে হাহাকার করে উঠেছিলেন ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই ১২টি বছর!’ ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ে সেই উচ্চারণ একেবারে বুকে গিয়ে বেঁধে। মো. বাবুলের অভিনয় করতে হয়নি। এটা তাঁর জীবনের সত্য। কিন্তু তিনি যদি অভিনয় করতে পারতেন, গলায় যথেষ্ট নাটকীয়তা আর চোখে জ্বালা নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে যদি বলতে পারতেন, যদি পত্রিকার পাতা থেকে শুরু করে টেলিভিশনের খবর-টক শোসহ সবখানে সেই ধ্বনি উচ্চারিত হতো, যদি রাষ্ট্রের পাষাণ দেয়ালে তাঁর ফরিয়াদ প্রতিধ্বনি তুলে জানতে চাইত, ‘কে ফিরিয়ে দেবে আমার যৌবনের ২৫টি বছর?’ তাহলে কী জবাব হতো আমাদের, সাধারণের, সরকারের, প্রশাসনের, বিচার বিভাগের?

আশ্চর্য নয় কি? বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটক থাকা ব্যক্তিদের সবার ফরিয়াদের ভাষা এক! গত বছরের মার্চে ২২ বছর কয়েদ খাটা সাতক্ষীরার কৃষক জোবেদ আলীও বলেন, ‘আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো কে ফিরিয়ে দেবে?’ (যুগান্তর, ০৪ মার্চ ২০১৬)। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ২২ বছর বিনা অপরাধে বন্দী আরেক কৃষক ফজলু মিয়াও জানতে চান, ‘কে ফেরত দেবে আমার জীবন?’ যুবক অবস্থায় আটক হয়েছিলেন, আর এখন তিনি প্রায় বৃদ্ধ। জীবন তো সবার একটাই। আপনার জীবন অপরে খরচ করে ফেলল, আপনি কষ্টকর কারাবাসে পুড়ে পুড়ে ঝামা হয়ে গেলেন। এই জীবন কেমন জীবন? এই জীবনের কারিগর কে? ভাগ্য নাকি রাষ্ট্র? ভাগ্যের দোহাই দিয়ে মাথার ওপরের ক্ষমতাকে ছাড় দিলে দুর্ভাগ্যও কোনো দিন আমাদের ছাড়বে না।

বাবুল ও ফজলু মিয়ারা সবাই গরিব। তাঁরা সমাজের সেই অংশের মানুষ, যাঁদের জীবন খরচযোগ্য। বিত্তবান ও যোগাযোগওয়ালা পরিবারের কোনো সদস্যকে এভাবে এত দিন বিনা বিচারে আটক রাখার উদাহরণ খুবই বিরল। ভাগ্য কেন গরিবদেরই কটাক্ষ করে; পুলিশ কেন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব মামলায় ওই শ্রেণির মানুষকেই বেশি আটকায়? কেন গণগ্রেপ্তারের মৌসুমে রাস্তা থেকে এসব মানুষকেই তুলে নেওয়া হয়?

‘মামলার বাদী নজরুল কিংবা তদন্ত কর্মকর্তা আশরাফ কখনোই আদালতে হাজির হননি। মামলার তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করেন তৎকালীন মহানগর হাকিম ফারুক আহমেদ খান। তাঁর বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও তাঁকেও আদালতে হাজির করেনি পুলিশ।’ (প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) আদালত বাবুলের খালাসের রায়ে বলেছেন, ‘মামলার বাদী, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ডকারী বিচারকসহ অন্য সাক্ষীদের আদালতে হাজির করানোর জন্য আদেশের কপি পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো পক্ষই মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা ও জবানবন্দি রেকর্ডকারী বিচারককে আদালতে হাজির করানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।’

বাবুলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলে আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়। এই রাষ্ট্রপক্ষে পুলিশ আছে, বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা আছেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আছেন। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোর কত স্তর, কত ক্ষমতাবান, কত আইন-নিয়ম-বিধি, কত প্রতিষ্ঠান; কেউই বিনা বিচারে জীবন ক্ষয়ে ফেলার এই অবহেলার দায় এড়াতে পারে না। তারা সবাই মিলেও কি ফিরিয়ে দিতে পারবে বাবুলের জীবন?

জেলে আটক থাকা অবস্থায় বাবুলের বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মা-ও মারা যান কিছু পরে। ভাইবোন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তিনি জানেন না। চোখের জলে শুধু মা–বাবার গল্প করেন। অপরাধের বিচার না করাও যেমন অবিচার, ​তেমনি নির্দোষের শাস্তি পাওয়াও অবিচার।

বাংলাদেশে কারাগার আছে ৬৭টি। এগুলোতে কত বাবুল বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আয়ুক্ষয় করে চলেছেন, তার কোনো তথ্য নেই। দেশের ২৫টি কারাগারে পাঁচ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় বিনা বিচারে ৪৬২ জন বন্দী থাকার কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটি। (যুগান্তর, ৮ জানুয়ারি ২০১৭) গত নভেম্বরের তথ্য, শুধু কাশিমপুর কারাগারেই পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার আসামি রয়েছেন ৩০ জন (বিবিসি)। এ দেশে আশার চেয়ে আশঙ্কার পাল্লাই ভারী। আমাদের আশঙ্কা, ৬৭টি কারাগারে দীর্ঘদিন
বিনা বিচারে আটক থাকা বন্দীদের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। আমরা নতুন নতুন বিভাগ ঘোষণা করে প্রশাসনের মাথা ভারী করি, কিন্তু সেই প্রশাসন বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা দূর করায় কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মানুষের জীবন এত অনাদরে, এত অবহেলায় নষ্ট হতে দিতে আমাদের অসুবিধা হয় না।

প্রধানমন্ত্রী গত বছরের এপ্রিল মাসে বলেছিলেন, ‘যাতে কেউ বিনা বিচারে কারাগারে আটক থেকে কষ্ট না পায়।’ (প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল ২০১৬)। তবু বাবুল, ফজলুদের মতো লোকেরা কেঁদে কেঁদে জবাব চান।

ছাত্রাবস্থায় আন্দোলন করার ‘অপরাধে’ আমি কিছুদিন আমাদের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলাম। যে ওয়ার্ডে ছিলাম, তা ছিল বিচার-চলা হাজতিদের দিয়ে ভরা। ১০০–র জায়গায় ৫০০ জন থাকতাম। তার মধ্যে গাদাগাদি মানুষ, তার মধ্যে নোংরা পানি-মেঝে-কাপড়, তার মধ্যে প্রাপ্য খাবার বা জায়গা নিয়ে মানুষে মানুষে কুকুরের মতো কামড়াকামড়ি, তার মধ্যে নিত্য মারামারি, তার মধ্যে বিচারের অপেক্ষায় থাকা মানুষের দেয়ালে মাথা ঠুকে রক্তাক্ত হওয়া, তার মধ্যে ঘুমানোর জায়গা না পেয়ে পেয়ে কারও কারও পাগল হয়ে যাওয়া।

 তার মধ্যে রাজ্জাক নামের এক মধ্যবয়সী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আটক ছিলেন। কলাবাগানের যে মেসে থাকতেন, সেখানে এক ছাত্র খুনের মামলার আসামি তিনি। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে হাজতিদের গুনে রাখা ও খাতায় নাম মেলানোর দায়িত্ব দিয়েছিল। কাজটা রেজিস্ট্রারের, আমরা বলতাম রাইটার। কারণ, তিনি খাতায় সবার নাম তুলতেন এবং প্রতিদিন গুনে গুনে মেলাতেন। তাঁর মতো ভালো মানুষ আমি কম দেখেছি। বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছে তিনি ছিলেন নির্দোষ। আর চরিত্রগুণে তিনি সবার শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। অতি বড় ত্যাঁদড় মাস্তানও তাঁর কথা শুনত। এই মানুষ এক দশক পর যখন জামিন পান, তখন দেখেন তাঁর কিচ্ছু নেই। একটা বাস কিনে ভাড়ায় চালাতেন। সেই বাসের কঙ্কালটা শুধু পেয়েছিলেন। ‘দেশে তখন মোবাইল আইসাছে, চিঠি বন্ধ হইয়াছে’ কয়েক বছর হলো। তাঁর একটা মোবাইল ফোন ছিল। একসময় মেসের ভাড়া পরিশোধ করতে সেটাও বিক্রি করে দেন। ঠিকানাহারা সেই মানুষটার আর দেখা পাইনি। কারাগারে বিনা বিচারে আটক থাকার জ্বালা যেমন আমি তাঁর মধ্যে দেখেছি, আবার দেখেছি ওরকম দুঃসহ অসহায়ত্বেও মানুষ কীভাবে মানুষ থেকে যায়।

নিরপরাধের নিরপরাধ থেকে যাওয়ার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়; সেটা কারাগারেই হোক আর বাইরেই হোক। কিন্তু যাঁদের অবহেলা, ষড়যন্ত্র আর স্বার্থের কারণে বাবুলদের মতো মানুষের জীবন খরচ হয়; তাঁদের কি কোনো মূল্যই পরিশোধ করতে হবে না? প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বাবুলের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘২৫ বছর জেলে থাকার জন্য যে কর্তব্য অবহেলা হয়েছে, তার জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত। যাতে ভবিষ্যতে সহায়-সম্বলহীন তথাকথিত আসামির জীবন আমাদের বিচারব্যবস্থা এভাবে ধ্বংস না করে। রাষ্ট্রের কর্তব্য হবে বাবুলের প্রতি নষ্ট বছরের জন্য অন্তত ২ লাখ টাকা করে অবিলম্বে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া।’

বাবুলেরা তবু ঝামার মতো হলেও জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু প্রতিদিন ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে যাঁরা নিহত হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যেও কি নিরপরাধ নেই? বিচার ছাড়া হত্যার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না। তবু সেই দাবি না হয়
না–ই তুললাম, আমাদের ৬৭ কারাগারের ২৫টিতে অন্তত ৪৬২ জন বিনা বিচারে আটক থাকেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ যদি বাবুলের মতো নিরপরাধ হন, তাহলে ওই একই আইনব্যবস্থার হাতে বিনা বিচারে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যেও এ রকম নিরপরাধ কেন থাকবে না? তাঁদের হয়ে আমাদেরই কথা বলতে হবে। কারণ, জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানানোর মতো জীবনটাও তাঁরা হারিয়েছেন প্রশ্নহীন ‘বন্দুকযুদ্ধে’!

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক  লেখক

faruk.wasif@prothom-alo.info