Thank you for trying Sticky AMP!!

বাল্যবিবাহের তথ্যবিভ্রাট ও একটি হটলাইন

এ মাসের শুরুতে ইউনিসেফের প্রকাশিত একটা রিপোর্টে (প্রথম আলো, ৭ মার্চ ২০১৮) বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহের শতকরা হারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চতুর্থ। বাংলাদেশের ওপরের তিনটি দেশ আফ্রিকার দরিদ্র সাব-সাহারা অঞ্চলের। আরও বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে বাল্যবিবাহের হার কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ছে।

পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় যখন বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে, তখন বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার বাড়ছে। তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইউনিসেফের তথ্যের ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গেছে যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার অনেক কমে এসেছে। কিন্তু তিনি কোন গবেষণার কথা বলছেন, তা প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদন পড়ে বোঝা গেল না। এই সংবাদ অনুযায়ী বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে বাল্যবিবাহের হার ৫২ শতাংশ। এই হিসাবটি পাওয়া গেছে ২০১৫ সালে ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের করা বহুমাত্রিক সূচক নির্ধারণে পরিচালিত গুচ্ছ জরিপ থেকে।

এখানে লক্ষণীয়, এই জরিপ সংক্ষেপে এমআইসিএস (মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে) ২০১২-১৩ নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে এর প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয়। এই জরিপের হিসাব অনুযায়ী ২০-২৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে হয়ে যায় ১৮ শতাংশের আর ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হয়ে যায় ৫২ শতাংশের। এটিই হলো সেই সরকারি হিসাব। তাই এখন যখন ইউনিসেফ বলছে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হয়ে যায় ৫৯ শতাংশের, সেটিতে সরকারের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হচ্ছে।

এই ৫৯ শতাংশের হিসাবটি কিন্তু এসেছে আরেকটি জরিপ থেকে, যেটি আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন) তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে। এটি ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত হয় এবং ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ) নামে পরিচালিত। এই জরিপের ২০১৪ সালের উপাত্ত থেকেই এই ৫৯ শতাংশ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে ইউনিসেফ বাংলাদেশের উপপ্রতিনিধি সীমা সেনগুপ্ত এক ই-মেইল বার্তায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে (জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ) এবং এমআইসিএস (গুচ্ছ জরিপ)—এ দুটি পৃথক জরিপ ছিল। দুই জরিপের নমুনা নির্বাচন পদ্ধতিও ভিন্ন ছিল। তাই দুটি জরিপের ফলাফলে কিছুটা পার্থক্য এসেছে (৫-/‍+), যা গ্রহণযোগ্য। দেশে বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার ৫২ থেকে ৫৯ শতাংশের মাঝামাঝি।’

৫২ শতাংশ হোক আর ৫৯ শতাংশ হোক, দুটিই এখন থেকে ৪-৬ বছর আগের হিসাব। ২০১৬ বা ২০১৭ সালে করা এমন কোনো জরিপ নেই, যেটা দেখে সাম্প্রতিক সময়ের বাল্যবিবাহের হার সম্বন্ধে ধারণা করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা হয়তো এ বিষয়ে একটা ধারণা দিতে পারবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজাখুঁজি করে যেটা পেলাম, সেটা হলো বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৬। এটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৬, এই পাঁচ বছরে নারীর প্রথম বিয়ের সময় গড় বয়স ১৮ দশমিক ৪-এ অপরিবর্তিত আছে, কিন্তু গ্রামের নারীদের প্রথম বিয়ের গড় বয়স ১৮.২ থেকে কমে ১৭.৯ হয়েছে। এই উপাত্ত একটি ধারণা দিতে পারে যে সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিবাহের পরিস্থিতিতে তেমন কোনো উন্নতি হয়ইনি, বরং কিছুটা অবনতি হয়েছে।

এর চেয়েও সাম্প্রতিক আরেকটি জরিপ, যেটি ২০১৭ সালে ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় করা হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে। এই জরিপ হলো ‘অ্যাসেসমেন্ট অন কভারেজ অব বেসিক সোশ্যাল সার্ভিসেস ইন বাংলাদেশ (বাংলাদেশে মৌলিক সামাজিক সেবা কাভারেজের মূল্যায়ন)’ এবং প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এই রিপোর্টে বাল্যবিবাহের হার কমার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু যাঁরা এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন, তাঁরাই পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন যে এই জরিপে বিয়েসংক্রান্ত তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়।

তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী ৫৯ শতাংশ যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার, সেটাই মেনে নিতে হচ্ছে। বাল্যবিবাহের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এ রকম তথ্য ঘাটতি বেশ হতাশাব্যঞ্জক।

ইউনিসেফের ওই একই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার বাল্যবিবাহের হারে উন্নতির জন্য ভারতকে বেশ কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে। ইউনিসেফের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার সময় বিবিসিতে একটি সংবাদ (দ্য গার্ল হু স্যাবোটাজড হার ওউন ওয়েডিং) পরিবেশিত হয় ভারতের রাজস্থানের ১৩ বছরের মেয়ে মনিকাকে নিয়ে। তার বাবা গণেশ, মা অন্য মানুষের বাসায় কাজ করেন, ময়লা পরিষ্কার করেন। ওরা নিম্নবর্ণের, তাই ওদের সঙ্গে কেউ তেমন একটা মেশে না। ওর বড় বোন রজনী, যার ১৮ পার হয়ে গেছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে। তাই বাবা-মা ভেবেছেন দুজনকে একসঙ্গে বিয়ে দিতে পারলে খরচ বেঁচে যায়। মনিকার বিয়ের আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। এমন সময় সে তার দাদির ফোন থেকে ১০৯৮ নম্বরে একটা ফোন করল। এটি একটি জাতীয় হটলাইন, যেটি চাইল্ডলাইন নামে পরিচিত। এটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং শিশুদের যেকোনো সমস্যা যে কেউ জানাতে পারে। মনিকা উপায়ন্তর না দেখে এই চাইল্ডলাইনের সাহায্য নেয়। চাইল্ডলাইনের দিল্লি অপারেটর সঙ্গে সঙ্গে প্রীতি যাদবের কাছে খবর পৌঁছে দেয়। প্রীতি রাজস্থানে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালায় এবং এ ধরনের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। খবর পেয়েই প্রীতি স্থানীয় পুলিশ এনে মনিকার বিয়ে আটকে দেয়।

আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। মানব ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় নারীদের পশ্চাৎপদ রেখে উন্নতি করতে পারেনি। নারীদের পশ্চাৎপদ রাখার একটা মোক্ষম উপায় হচ্ছে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সংসারের জাঁতাকলে পিষে মারা। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের ভূমিকা পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় প্রশংসনীয়। কিন্তু বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে একটা বিরাট অন্তরায়। ইদানীংকালে বাল্যবিবাহ নিয়ে অনেক আলোচনা, বিতর্ক সংবাদমাধ্যমে এসেছে। আমরা দেখেছি, কিছুটা হলেও সচেতনতা তৈরি হয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু যেতে হবে এখনো অনেক দূর।

তাই দরকার হটলাইনের মতো কিছু অতিপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কারণ আমরা জানি না, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো মনিকা হয়তো ভাবছে—আহা! যদি থাকত এ রকম একটা ফোন নম্বর!

ছোট্ট মনিকাদের জীবনটাই হয়তো বদলে দেওয়া যায় একটি নম্বরে!

রুশাদ ফরিদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক