Thank you for trying Sticky AMP!!

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকেরাই সুরক্ষা দিতে পারেন

দেশে করোনা রোগী সন্দেহে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনার কথা আমরা শুনেছি। এই ধারা বাড়তে পারে। কোনো ভাড়াটের করোনার উপসর্গ প্রকাশ পাবে, কারও বা পাবে না। কিন্তু সন্দেহের দোহাই দিয়ে যে উচ্ছেদ চলবে না সেটা বলা যায় না। বৈরিতার কারণেও বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াকে করোনার ‘কলঙ্ক’ দিতে পারে। ভাড়াটেদের সুরক্ষার বিষয়টি তাই জরুরি।

ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাড়া বাড়ি থেকে বিতাড়নের উদ্যোগের খবর ছড়িয়ে পড়লে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে টিভিতে বলেছিলেন, তিনি বাড়িওয়ালাদের নোটিশ দেবেন। কোথা থেকে টাকা এনে বাড়ি তৈরি করা হলো, সেটা জানতে চাইবেন। তাঁর কথাটি বোধগম্য। কিন্তু যাঁরা অবৈধ উপার্জনের টাকায় বাড়ি বানিয়েছেন, তাঁদের টাকার উৎস সব সময়ই অবৈধ। তাঁরা স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাড়া বাড়ি থেকে তাড়াতে না চাইলে দুদক আর তাঁদের বিষয়ে কিছু বলবে না— এটা নৈতিক নয়, আইনসম্মত নয়।

দুদক চেয়ারম্যানের পর ১৭ এপ্রিল ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান হুঁশিয়ারি দেন। তাঁর কথা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধের সম্মুখযোদ্ধাদের ভাড়া বাসা থেকে উচ্ছেদ করা চলবে না। চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিক ও সংশ্লিষ্ট ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু আইন তো করোনোযোদ্ধাদের সুরক্ষা দেয়নি। আইন তো এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কল্পনা করেনি। আইন চেনে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের। আর তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে নিয়ন্ত্রককে। এই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আছেন অধস্তন আদালতের বিচারকগণ।

লকডাউনের আইনি প্রভাব কী হবে, কাকে কেমন ভোগাবে, তা সেভাবে ভাবাই হয়নি। হুট করে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। তার অন্যতম নজির বাড়িভাড়া আইন। সর্বস্তরের আদালত লকডাউনে পড়েছে। অবশ্য জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট খোলা ছিল। কারণ, এই পথে অভিযুক্তদের কারাগারে পাঠাতে হয়। কিন্তু বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন মুখ থুবড়ে পড়লে কী ক্ষতি, তা সংশ্লিষ্টদের মাথায় ছিল না। ইতিমধ্যে টানা দুই মাস পেরিয়ে গেছে। শুধু স্বাস্থ্যকর্মীদেরই, সাধারণ ভাড়াটেদেরও রোগী সন্দেহে উৎখাত শুরু হয়ে গেছে।

অবশ্য মানবিকতার গল্পও আছে। নারায়ণগঞ্জে দুরকম খবরই আছে। ২২ ভাড়াটে পরিবারের বাড়িভাড়া ও আনুষঙ্গিক বিল মওকুফসহ খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছেন এক বাড়ির মালিক। কিন্তু আরেক মালিকের বিরুদ্ধে দুই মাসের ভাড়া বকেয়ার কারণে এক সন্তানের জননীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য কেউ কেউ পরিস্থিতির সুযোগও নিতে পারেন। যাঁরা ঋণের টাকায় বাড়ি করেছেন, তাঁদের কিস্তি বাধা। মওকুফ হয়েছে শুধু সুদ। সেই বাড়িওয়ালারা যথাসময়ে ভাড়া না পেলে বিপাকে পড়বেন। সুতরাং এটা মনে করার কারণ আছে, বাড়িভাড়া আইনটির অনুশীলন ভবিষ্যতে বেশ বাড়বে।

১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বলছে, নিয়ন্ত্রক বাড়ি ভাড়া আইন কার্যকর করবেন। তাই দেশের লাখ লাখ ভাড়াটের বিপদের বন্ধু হলো নিয়ন্ত্রক। এই নিয়ন্ত্রক হলেন সহকারী জজ। ভাড়াবাড়ি শাসন ঠিক বিচারবিভাগীয় কার্যক্রমের অংশ নয়। তবে নিশ্চয় আধা বিচারবিভাগীয়। আইন বলছে, সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করবেন। দরকার পড়লে নির্দিষ্ট এলাকায় অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক বা উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করবেন। সারা দেশে অবশ্য কেবল সহকারী জজরাই নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন। এখন ভুক্তভোগীরা তাঁদের দেখা পান না। কারণ তাঁদের অফিস বন্ধ।

সরকারি ছুটি ও সুপ্রিম কোর্টের ছুটি কিন্তু আলাদা। সরকার কোর্টের ছুটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন না। সরকারি ছুটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ছুটি দেন। কিন্তু সেটা আদালতের কর্তৃত্বে। সুপ্রিম কোর্টের ছুটি সহকারী জজদের জন্য প্রযোজ্য। নিয়ন্ত্রকদের কথা কেউ ভাবেননি।

দেশের সকল নিয়ন্ত্রকই সহকারী জজ। তাঁদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জেলা জজের কাছে আপিল করা যায়। সুতরাং বাড়ি ভাড়া আইনটি যাঁরা কার্যকর করে চলছিলেন, তাঁদের অবিলম্বে অফিসে যোগদান জরুরি। অন্যথায় ভাড়াটেরা উচ্ছেদের ঝুঁকিতেই থাকবেন। সেটা চিকিৎসক, নার্স, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য বা সাংবাদিক যেই হোন, উচ্ছেদের ভয় তাঁদের ঘুচবে না।

প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া আইনটিতে গলদ অনেক। তবু সেটা ভাড়াটে-বান্ধব আইন হিসেবেই পরিচিত। এর কতগুলো বিধান আছে, যা শোধরানোর দাবি রাখে। করোনো আমাদের বহুদিন ভোগাবে। নতুন সংকট বয়ে আনবে। সুতরাং আইনটির ত্রুটিগুলো দূর করতে হবে। দুদক বা ডিএমপি কমিশনারের হুমকির ওপর ভরসা রাখা যাবে না। কারণ তা ঠিক আইনসংগত নয়।

বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের সম্পর্কের বিচিত্রতা নিয়ে বাংলা সাহিত্য ঠাসা। তবে সাধারণভাবে বলা চলে সম্পর্কটা মোটেই মধুর নয়। বাড়িভাড়া বিষয়ে মাসে ৫০টির বেশি মামলা হয় শুধু রাজধানীতেই ঘটে। গত দু মাস ধরে কোনো মামলা নেই। কিন্তু কোর্ট যখন খুলবে, তখন মামলার হিড়িক পড়বে। শাহবাগ, রমনার মতো গুরুত্বপূর্ণ আট-নয়টি থানার দায়িত্বে একজন নিয়ন্ত্রক। এই এলাকাতেই সাধারণ সময়ে মাসে ২৫টি মামলা হয়। বেশির ভাগই বাড়িওয়ালার উচ্ছেদ নোটিশের বিরুদ্ধে। অবশ্য সংখ্যায় অল্প হলেও এখনো টাইটেল স্যুটের (মালিকানা সত্ত্বের) মামলা করেন অনেক ভাড়াটে।

এই আইনে পেশ করা দরখাস্তের শুনানি তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। সুতরাং যত দরখাস্ত পেশ করা ছিল, তা তিন মাস পরে মরে যাবে। আর একটা পরিহাস হলো, নিয়ন্ত্রকের অফিসের দরজা অনির্দিষ্টকাল বন্ধ। এটাই আপনাআপনি বাড়িওয়ালার পক্ষে যায়। কারণ নিয়ন্ত্রকের অফিস বন্ধ থাকায় ভাড়াটেরা আইনের সুযোগ নিতে পারছেন না। আইন ভাড়াটেদের আকস্মিক বিতাড়ন রহিত করেছে। বাড়িভাড়া জমা দেওয়ার জন্য আদালতের তদারকিতে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। ভাড়াটে নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে ভাড়ার টাকা জমা দেওয়ার আদেশ পেলে বিরোধের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাড়িওয়ালা আর উচ্ছেদ করতে পারবেন না। কিন্তু এখন নিয়ন্ত্রকের অফিস বন্ধ থাকায় ভাড়াটেরা এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারছেন না।

কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয় রয়েছে, যা করোনাকালে ভাড়াটাকে একটা অন্যায্য প্রতিকূল অবস্থায় ফেলতে পারে। ভাড়ার হার যৌক্তিক করতে আইনটি কোনো সঠিক সূত্র দিতে পারেনি। এর ওপরে একটি শর্ত আছে, যা এই করোনাকালে ভাড়াটেকে উচ্ছেদের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। আইনটির ১৮ ধারার একটি উপ দফা প্রণিধানযোগ্য। আইনটি বলছে, ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন অথবা ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ভাড়াটিয়া এই আইনের অধীন অনুমোদনযোগ্য ভাড়া যত দিন পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় আদায় করবেন এবং ভাড়ার শর্তাদি পূরণ করবেন, তত দিন পর্যন্ত বাড়ির মালিকের অনুকূলে বাড়ির দখল পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো আদেশ বা ডিক্রি প্রদান করা যাবে না। কিন্তু শর্ত হলো, ভাড়াটিয়া এমন আচরণের জন্য দোষী, যা সংলগ্ন বা পার্শ্ববর্তী বাড়ির দখলকারীগণের নিকট উৎপাত বা বিরক্তি স্বরূপ, সে ক্ষেত্রে আগের রক্ষাকবচ প্রযোজ্য হবে না।

দোষী নির্ধারণ করবে কে? কিসে উৎপাত, কিসে বিরক্তির উদ্রেক ঘটে, সে বিষয়ে আইন নীরব। তার মানে এটা সংজ্ঞায়িত করবেন মালিক। এই বিধান করোনাকাল বলে নয়, এটা এভাবে থাকতে পারে না।

নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালনকারী একজন বিচারক বলেন, কেউ হঠাৎ ভাড়া বাসা থেকে উচ্ছেদের শিকার হলে নিয়ন্ত্রকের কাছে যেতে পারেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে শুনানি করেও দেওয়ানি আদালতের মতো কোনো স্থিতাবস্থার আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার তাঁদের নেই। ভারতের আইনেও তা নেই। তবে সুপ্রিম কোর্ট এক রায় দিয়ে সেই শূন্যতা পূরণ করেছেন। ভারতীয় নিয়ন্ত্রকেরা তাই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিতে পারেন।

প্রশ্ন হলো, করোনাকালে এই নিয়ন্ত্রকেরা কীভাবে কাজ করবেন। সুপ্রিম কোর্ট ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সীমিতভাবে আদালত চালু করতে যাচ্ছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে সারা দেশের নিয়ন্ত্রকদের দ্বার দ্রুত খুলে দেওয়াই এই মুহূর্তের জরুরি কাজ।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com