Thank you for trying Sticky AMP!!

বিজেপির নীল আকাশে কালো মেঘ

নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। ছবি: রয়টার্স

বেশ মেঘমুক্ত ও নীলে নীল ছিল আকাশটা। সেই আদিগন্ত সুনীলে দুই-এক খাবলা সাদা মেঘ কখনো অলস গাভির মতো ভেসে এসে বিলীন হতো। এত দিন এই ছিল দৃশ্যমান। অকস্মাৎ কোথা থেকে কে জানে, ঈশান না নৈঋ৴ত কোনো কোণ থেকে ভেসে আসা এক টুকরা কালো মেঘ সুনীল সেই আকাশে কালো ওড়নার ছায়া ফেলে ভ্রুকুটি দেখাতে শুরু করেছে! কে জানে, এ কোন অশনিসংকেত! নরেন্দ্র মোদির বিজেপির কাছে বছরটা মোটেই সুডাক ডেকে শেষ হচ্ছে না।

অথচ শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত বছরটা কী নিস্তরঙ্গই না ছিল!

ভারতীয় রাজনীতির ‘ন্যারেটিভ’ রাতারাতি আমূল বদলে দিয়ে জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে মাঝ বছরে লোকসভার বৈতরণি নরেন্দ্র মোদি হাসতে হাসতে পেরিয়ে গিয়েছিলেন। আগেরবারের প্রাপ্য ২৮২ সংখ্যাটাকে এক টানে ৩০৩-এ নিয়ে গিয়ে মোদি প্রমাণ করেছিলেন, দেশে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে তিনিই এক থেকে এক শ। বিরোধীদের হতবাক করে বুঝিয়েছিলেন, তিনিই যন্ত্রী। যেমন বাজাবেন, তাঁর সুরে তেমনই নাচতে হবে বাকিদের। দেশি রাজনীতির এমন ধারার নিয়ন্ত্রক বহু বছর কেউ দেখেনি!

অথচ মাত্রই পাঁচটা মাস! কেমন করে যেন বদলে যেতে চলেছে সেই চেনা রাজনীতির প্রবাহ। বছর শেষে অমিত শক্তিধর মোদি-শাহ জুটির বলিরেখা তাই গভীর ও গাঢ়। মুখে চোখে চিন্তার ছাপ! তাঁদের জমানায় তাঁদের দলের অধীনে থাকা সারা দেশের ৭৩ শতাংশ ‘ফুট প্রিন্ট’ হঠাৎই ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে! দুশ্চিন্তা হওয়ারই কথা।

লোকসভা জয়ের ছয় মাসের মধ্যে প্রথমে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানা এবং তারপর ঝাড়খন্ডে পদস্খলনের কারণ খুঁজতে শান্ত চিত্তে মনোনিবেশ করলে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের মনে অটল বিহারি বাজপেয়ির মুখটা ভেসে ওঠা উচিত। অগ্রজ এই পূর্বসূরির দিকে তাকালে পার্থক্যটা জলবৎ তরলং হয়ে যায়।

বাজপেয়ির আমলে জোট শরিকেরা যে গুরুত্ব পেত, মোদি-শাহ জমানায় তার ছিটেফোঁটাও কারও মেলে না। বাজপেয়ি তাঁর শরিকদের ‘স্পেস’ দিতেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পরামর্শ করতেন। অভিমত জানতেন। শরিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতে একটা কো-অর্ডিনেশন কমিটি গড়া হয়েছিল সমন্বয়ের জন্য। তার বৈঠক হতো নিয়মিত। নতুন জুটি সেসবের তোয়াক্কাই করেননি। সমন্বয় সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো কর্পূরের মতো উবে গেছে। শুধু তা-ই নয়, শরিকদের জায়গা দখলের নিরন্তর এক প্রচেষ্টায় এই নতুন জুটি সদা ব্যস্ত। বিশেষ করে ২৮২ থেকে ৩০৩-এ উত্তরণের পর।

এই অবমাননা ও অশ্রদ্ধার ফল কী হতে পারে, মহারাষ্ট্র তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কিন্তু বিজেপি তা থেকে শিক্ষা নিল না। তিন দশকের সঙ্গী শিবসেনা যখন মুখ্যমন্ত্রিত্ব ভাগাভাগির প্রশ্নে অনড়, বিজেপিও তখন নিজস্ব দাবিতে অটল থেকে হেলায় মহারাষ্ট্রকে হারাল! ঝাড়খন্ডেও হলো সেই ঔদ্ধত্যের পুনরাবৃত্তি। শরিক দল অল ঝাড়খন্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (আজসু) বাড়তি কয়েকটা আসনের দাবি মেনে নিলে বিজেপিকে ওই রাজ্যে এভাবে মুখ কালো করে হারতে হতো না। রাজ্যে এবার মাত্র দুটি আসন জিতলেও আজসু ভোট পেয়েছে ৮ শতাংশের বেশি। বিজেপি ও আজসুর মিলিত ভোটের হার কংগ্রেস-জেএমএম-আরজেডির চেয়ে ৬ শতাংশের বেশি! একজোট থাকতে পারলে বিরোধীরা উড়ে যেত। শরিকি অসন্তোষ দ্রুত ছড়াচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসিকে কেন্দ্র করে বিহারে নিতীশ ও চিরাগ পাসোয়ান, পাঞ্জাবে আকালি নেতা নরেশ গুজরাল বেসুরো গাইছেন। ঔদ্ধত্য যে মানুষ পছন্দ করে না, সেই বোধোদয় মোদি-শাহ জুটির হলে ভালো। আরও ভালো বাজপেয়ির রাজনীতি থেকে শিক্ষা নেওয়া।

ঝাড়খন্ডে বিজেপির দ্বিতীয় ভুল স্থানীয় ইস্যুগুলোকে অগ্রাহ্য করে জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান, কাশ্মীর, ৩৭০ অনুচ্ছেদ, অযোধ্যা, নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। অর্থনৈতিক মন্দা পিছিয়ে থাকা রাজ্য ঝাড়খন্ডের দরিদ্র আদিবাসীদের গভীর বিপর্যয়ের মুখে টেনে এনেছে। সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে জাতীয়তাবাদী জড়িবুটির ওপর আস্থা রাখা যে চরম আহাম্মকের কাজ, মোদি-শাহ জুটি হয়তো এখন তা অনুধাবন করছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় কিন্তু গা করেননি। ভেবেছিলেন, মোদি-ম্যাজিকেই কেল্লা ফতে হবে। মায়াজাল বিছাবে!

বিজেপিকে এবার দিল্লি দখলের লড়াইয়ে নামতে হবে। সময় আছে ছয় সপ্তাহের মতো। দিল্লি কিন্তু কঠিন ঠাঁই। দিল্লি দখলে রাখতে আম আদমি পার্টির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। গরিব, মধ্যবিত্ত এবং নারীর আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে তিনি নিখরচায় পানীয় জল দিচ্ছেন। ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ফ্রি করেছেন। চিকিৎসাব্যবস্থা সর্বজনীন করতে পাড়ায় পাড়ায় খুলেছেন অগুনতি মহল্লা ক্লিনিক। নিযুক্ত করেছেন ডাক্তার। ব্যবস্থা করেছেন ওষুধের। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় গরিবদের নিখরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। সরকারি বিদ্যালয়ে ২০ হাজার নতুন ক্লাস ঘর তৈরি করেছেন। সরকারি বাসে নারীদের ভাড়া লাগে না। সবচেয়ে বড় কথা, ৭০ টির মতো সরকারি পরিষেবা মানুষ যাতে ঘরে বসে বিনা ঘুষে পেতে পারে, সে ব্যবস্থা তিনি করিয়েছেন। ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন লাইসেন্স ও নানা ধরনের সরকারি সার্টিফিকেট পেতে আগে দালালদের খপ্পরে পড়তে হতো। এখন ঘরে বসে পাওয়া যাচ্ছে। লাইসেন্স-পারমিটের জন্য দালাল-দৌরাত্ম্য দিল্লিতে আজ অতীত। গরিব ও মধ্যবিত্তের কাছে কেজরিওয়াল সরকারের এই জনপ্রিয়তা মোকাবিলা বিজেপি কীভাবে করবে, নতুন বছর শুরুর চমক সেটাই।

বিজেপির কাছে বছর শেষের চ্যালেঞ্জ বিহার। এই চ্যালেঞ্জ কঠিনতর করে তুলেছে নাগরিকত্বসংক্রান্ত শাসকদলীয় সিদ্ধান্ত। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) ও নাগরিকত্ব তালিকা (এনআরসি) তৈরির উদ্যোগ গোটা দেশকে এই মুহূর্তে দুই শিবিরে ভাগ করে দিয়েছে। মোদি-শাহ জুটিকে এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি গত পাঁচ বছরে হতে হয়নি।

আসামের মতো সারা দেশে এনআরসি করা বিজেপির ঘোষিত সিদ্ধান্ত। মোদি-শাহসহ সব মাপের নেতারা বারবার তা বলে এসেছেন। কিন্তু আসামের এনআরসি হিতে বিপরীত হয়ে যাওয়ায় বিজেপি ঠিক করে আগে নাগরিকত্ব বিল পাস করিয়ে প্রতিবেশী তিন দেশের অ-মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করবে, পরে সারা দেশে এনআরসি আনবে। এটা করতে গিয়ে শুরু হয় আরও বিপত্তি। নাগরিকত্ব দানের প্রশ্নে বিরোধীরা যে ক্রমেই একজোট হবে, এমনকি শাসক জোট এনডিএর শরিকেরাও যে বেঁকে বসবে, মোদি-শাহ জুটি তা কল্পনা করেননি। দেশব্যাপী বিক্ষোভ মোকাবিলায় উল্টো পথে হাঁটতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ‘মিথ্যাবাদী’ প্রমাণ তো করেছেনই, হাস্যকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেও। শাক দিয়ে মাছ ভাজা ঢাকা দেওয়ার এই অপচেষ্টা কতটা সফল হবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। কারণ, প্রথমত, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। দ্বিতীয়ত, ‘অসাংবিধানিক’ এই সিদ্ধান্ত তরুণসমাজকে রাস্তায় নামিয়েছে। মত-বর্ণ-জাত-ধর্মনির্বিশেষে রাজ্যে রাজ্যে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। এই সিদ্ধান্ত শুধু মুসলমান নয়, সব ধর্মের গরিব, প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত, দলিত ও আদিবাসীবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের মেরুকরণ ঘটানোর সিদ্ধান্ত যে বুমেরাং হবে, মোদি-শাহ জুটি তা বুঝতে পারেননি। যদিও সেই চেষ্টায় কোনো ত্রুটি তাঁরা অবশ্য রাখছেন না। ভারতের আগামী দিনের রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্ত এটাই।

নাগরিকত্বসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। কিন্তু প্রয়োগের জন্য রাজ্যের সহযোগিতা দরকার। রাজ্যে রাজ্যে সিএএ এবং এনআরসির বিরোধিতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে নতুন ধরনের সাংবিধানিক সংকটও সৃষ্টি হতে পারে।

ভারতীয় গণতন্ত্রে পরিবর্তনই একমাত্র চিরকালীন। এটাই তার মাধুর্য। নইলে বিজেপির এমন নির্মেঘ সুনীল আকাশ কি আচমকা এভাবে বাদল মেঘে ছাইতে পারে? নতুন বছরে মোদি-শাহ জুটির চ্যালেঞ্জের চরিত্রটা কেমন হবে, বছরের শেষ সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি