Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদেশিদের আকৃষ্ট করার উপায়

বেড়ানো বা পর্যটন কেবল শারীরিক-মানসিক রিলাক্সেশন নয়। নয় এমনকি নিছক জ্ঞানান্বেষণের উপায়। মানুষের পর্যটনের স্বভাব-সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিনিময়, বিকাশ, বিবর্তন ও ইতিহাস সংরক্ষণে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
মাকাই কাজুমি ছিলেন হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। বান্ধবীর কাছে বাংলাদেশের রিকশা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় গল্প শুনে শুনে বাংলাদেশে না এসে পারেননি। আসার আগে কাজ চালানোর মতো বাংলা শিখে নিলেন কাজুমি। ঢাকায় এসে চেপে বসলেন এক রিকশায়। রিকশাওয়ালা কিছুদূর এগিয়ে আপনমনে গান গেয়ে উঠলেন। রিকশাওয়ালার সঙ্গে আধো বাংলায় কথা বলতে বলতে কাকতালীয়ভাবে বাউলগানের প্রত্যক্ষ পরিচয় পেলেন তিনি। তাঁর মনোযোগের মোড় এভাবে রিকশা থেকে ঘুরে গেল বাউলগানের দিকে। তিনি ছুটে গেলেন কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইজির মাজারে। সাঁইজির মাজারেই তিনি দীক্ষা নিতে চাইলেন লালনের গানের। কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছিল তাঁকে সেখানে। কিন্তু বাউলগান তাঁকে পুরোই আবিষ্ট করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। মাজারের একজন প্রবীণ বাউলের পরামর্শে কাজুমি শান্তিনিকেতনে ছুটলেন।
প্রিয় শিক্ষক মাসাহিকো তাগাওয়াকে জানিয়ে দিলেন যে তিনি আর পড়বেন না, বাউল হবেন; বাউলিয়ানা এমন এক জ্ঞান, যা চর্চা ও সাধনায় পাওয়া যায়। শান্তিনিকেতনে মাসের পর মাস সাধনায় তিনি কাজুমি থেকে হয়ে ওঠেন হরিদাসি বাউল। তবে শান্তিনিকেতন নয়, তাঁর হৃদয়মাঝারে কেবলই বাউলসম্রাট লালন সাঁই।
সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার আমেরিকান সেন্টারে বাংলাদেশে লোকসংস্কৃতি গবেষণার নয়া প্ল্যাটফর্ম ভাবনগর ফাউন্ডেশন আয়োজিত সেমিনারে এভাবেই অধ্যাপক মাসাহিকো তাগাওয়া আমাদের সঙ্গে জাপানের হরিদাসি বাউলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। হরিদাসির গানের ভিডিওচিত্র দেখে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগও হলো সেখানে।
প্রতিবছর জাপান থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে যত মানুষ আসে, তার প্রায় ছয় গুণ বেশি জাপানি বেড়াতে যায় ভারতে, আমাদেরই প্রতিবেশী দেশে। পর্যটনশিল্পে ভারতের বিনিয়োগ ও গবেষণামূলক প্রচারণাকেই এ জন্য কৃতিত্ব দিতে হয়। হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচারাল অ্যানথ্রোপলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক মাসাহিকো তাগাওয়া জানালেন যে জাপানিদের কাছে বাংলাদেশের থেকে এমনকি পাকিস্তানও দ্বিগুণ আকর্ষণীয় ভূখণ্ড। তাগাওয়া বলেন, জাপানিরা জানেন না বাংলাদেশে তঁারা কেন আসবেন! জানেন না, কী আছে বাংলাদেশে দেখার মতো, অভিজ্ঞতা লাভ করার মতো? তাঁর মতে, বাংলাদেশ হতে পারে পর্যটকদের লীলাক্ষেত্র, কেননা বাংলাদেশে দেখার আছে অনেক কিছু। কিছু বিষয় আছে, যা কেবল চোখ দিয়ে দেখার নয়, মন দিয়ে উপলব্ধি করার। সমস্যা একটাই, বাংলাদেশের এসব বৈচিত্র্যের খবর বিদেশিদের কাছে পৌঁছায়নি আজ পর্যন্ত।
১৯৭১ সালে নতুন দেশ বাংলাদেশের পরিচয় সাধারণ জাপানিরা পেয়েছিল বাউলগানের দেশ হিসেবে, ইউনেসকোর কিছু প্রতিবেদনের বদৌলতে। এরপর ইউনেসকোর উদ্যোগে একদল গবেষক ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে আসেন। তাঁরা এখানকার পাহাড়পুর, ষাটগম্বুজ মসজিদ, মহাস্থানগড়, কান্তজিউ মন্দির, পুঠিয়া, ছেঁউড়িয়া, সোনারগাঁ ইত্যাদি স্থান ভ্রমণ শেষে যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন, তাতে প্রাচীন পালযুগের সময়ে বিকশিত সভ্যতার সঙ্গে বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির সমৃদ্ধ গুণের সম্পর্কের কথা বলা হয়। বিদেশিদের কাছে এসব স্থানের পুরাকীর্তি ও অদ্যাবধি প্রবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব প্রকাশ করার প্রয়াস পায় ইউনেসকো।
২০০০ সালে বাংলাদেশে পর্যটনের গুরুত্ব তুলে ধরে জাপানি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ ভ্রমণের ওপর ছোট্ট একটি প্রকাশনা ট্র্যাভেল গাইড ফর বাংলাদেশ। তখনই বাংলাদেশে আসতে শুরু করে জাপানি পর্যটক। পাঠক, বাংলাদেশের রিকশা ও রিকশা পেইন্টিংয়ে আকৃষ্ট হয়ে এক জাপানি তরুণীর কর্মকাণ্ডের কথা আমরা নিশ্চয় ভুলে যাচ্ছি না। এই ট্র্যাভেল গাইডের ফলাফলই হচ্ছে এই রিকশা উৎসব। ২০১০ সালের পর বাংলাদেশে হঠাৎ করেই জাপানি পর্যটক বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেই ট্র্যাভেল গাইড ফর বাংলাদেশ–এর ২০১০ সংস্করণে বাউলগান ও বিশেষ করে লালন সাঁইয়ের গানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ইউনেসকো বাংলাদেশের বাউলগানকে মাস্টারপিস অব ওরাল অ্যান্ড ইনট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে উল্লেখ করে। এই মহৎ কর্মে তাগাওয়া ও কাজুমি ওরফে হরিদাসি বাউলের অবদান আমাদের কৃতজ্ঞ করে।
তারও আগে, ১৯৮৫ সালে গবেষক কইজুমি ফুমিও বাংলাদেশের বাউলগানকে তুলে ধরেছিলেন জাপানি পণ্ডিতদের সামনে। কৌতূহলোদ্দীপক যে সচেতন জাপানি নাগরিক নতুন দেশ বাংলাদেশের পরিচয় পান বাউলগানের দেশ হিসেবে, কেবলই দারিদ্র্য আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে নয়। জাপানে ২০০৪ সাল থেকে বাউল উৎসবও হয়। শান্তিনিকেতন ও ছেঁউড়িয়ার বাউলেরা সেখানে আমন্ত্রিত হন। অথচ বাউলগানের খাঁটি স্বাদ ও বাউল দর্শনের প্রকৃত চর্চার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা বাংলাদেশের এই গুপ্তস্রোতকে আমরা কি কখনো জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি? মাসাহিকো তাগাওয়ারা কিন্তু ভালোবেসে চিহ্নিত করেছেন যে বাউলগানই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। অন্যদিকে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক তরুণ গবেষক বার্টি কিবরিয়া বাউলপরম্পরার ধারাবাহিকতা তুলে ধরতে গিয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে আমরা বাউলগানকে নগরে উঠিয়ে আনার নামে সেগুলোর মধ্যে ফিউশনের দূষণ ঘটিয়েছি।
বাউলগান নিয়ে এই নিবন্ধ নয়। আমার উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প বিকাশের উপাদানগুলো আমরা কতটা চিহ্নিত করতে পেরেছি, সে বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ দেশে এখন পর্যটন মৌসুমের প্রারম্ভিক ঋতু। যদি যুক্তিহীন হরতালের রাজনীতি চলতে না থাকে, মাস খানেকের মধ্যেই পর্যটনের ভরা মৌসুম উপস্থিত হবে। পর্যটন করপোরেশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে আমরা দেশের মানুষই তেমন কিছু জানি না, বিদেশিদের আকৃষ্ট করার কোনো বন্দোবস্ত আছে কি না, তা-ও আমাদের জানা নেই। তবে আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও করার অনেক কিছু আছে। সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ আছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও।
শান্ত নূরুননবী: লেখক ও উন্নয়নকর্মী।