Thank you for trying Sticky AMP!!

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যে করোনার আঘাত

তেলের মূল্য বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। ছবি : রয়টার্স

বিশ্বব্যাপী চলমান করোনাভাইরাসের ছোবল মানবজাতির ইতিহাসে সম্ভবত সর্ববৃহৎ মহামারি। দেশে দেশে এর আঘাতে অবরুদ্ধ হয়েছে জনগোষ্ঠী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমগ্র শহর, এমনকি সমগ্র দেশ। করোনার আতঙ্কে প্রায় জনশূন্য হয়েছে সড়ক, মহাসড়ক, বন্দর; বন্ধ হয়েছে বা কমে গেছে যান চলাচল, ট্রেন বা জাহাজ, আকাশপথে বিমান; সীমিত হয়েছে বাণিজ্য, কলকারখানার উৎপাদন, বাজারের কোলাহল। বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তি তেলের মূল্য করোনার আঘাতে হয়েছে ধরাশায়ী। অর্থনীতির সহজ সূত্র অনুযায়ী যদি পণ্যের চাহিদা কমে কিন্তু সরবরাহ না কমে কিংবা সরবরাহ বেড়ে যায়, তাহলে পণ্যের মূল্য কমে যায়। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাবে টেনে ধরা অর্থনীতির কারণে তেলের চাহিদা বিপুলভাবে কমে গেছে, অথচ সরবরাহ কমেনি বরং বেড়েছে। আর এর ফলে তেলের মূল্যে শিগগির নেমেছে বিরাট ধস।

২০১৮ সালব্যাপী যে তেলের মূল্য প্রতি ব্যারেল ৭০ ডলারের আশপাশে এবং ২০১৯ সালব্যাপী যেটি প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলারের আশপাশে ছিল, করোনাভাইরাসের প্রভাবে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তা রাতারাতিই নেমে গিয়ে প্রতি ব্যারেল ৪০ ডলার মূল্যে বিক্রি হয়। তবে এটি সেখানেই থামেনি বরং মার্চ মাসে এটির পতন অব্যাহত থাকে এবং মধ্য মার্চে এর মূল্য প্রতি ব্যারেল ৩০ ডলারে এবং তারপর তা ব্যারেল ২০ ডলারে নেমে যায়। তেল বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি ইতিহাসে তেলের মূল্যহ্রাসের সর্ববৃহৎ পতন। আবার কোনো কোনো অতি উৎসাহী বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব আগামী দিনগুলোয় অপরিবর্তিত থাকলে বিশ্ব অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে পৌঁছাবে এবং তার ফলে তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি ৫ ডলারে নেমে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে অনেকে মনে করেন, এসব অতি উৎসাহী বিশ্লেষণ নেহাতই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তা তেলের বাজার নিয়ন্ত্রকদের মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখার কৌশলমাত্র।

তেলের মূল্যের এত বড় পতন কেবল করোনাভাইরাসের প্রত্যক্ষ নেতিবাচক কারণে হয়েছে, তা নয়। বরং এর নেপথ্যে পরোক্ষ অপর একটি কারণও বিদ্যমান। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বব্যাপী তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে তেলের মূল্য কমে যায়, এটি ছিল প্রত্যক্ষ কারণ। মূল্যহ্রাসের অপর কারণটি হলো চাহিদা কমা সত্ত্বেও তেল সরবরাহ বৃদ্ধি। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে তেল সরবরাহ বাড়াল কে এবং কেন? এর উত্তরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে তেল নিয়ে বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈরী ও প্রতিহিংসামূলক আচরণের স্বরূপ। আবার এই বিষয়ে নাট্যমঞ্চে উপস্থাপিত একটি নাটকের শেষ অংশের মতনই বিপরীতমুখী অপর এক লুক্কায়িত চক্রান্তের স্বরূপ ফুটে ওঠে। বিষয়টি ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

করোনাভাইরাসের প্রত্যক্ষ কারণে যখন তেলের মূল্যের পতন ঘটতে থাকে, তখন বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ ও রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেক এই সিদ্ধান্ত নেয় যে মূল্য পতনের হার ঠেকাতে বিশ্বের মোট তেল উৎপাদন অর্থাৎ সরবরাহ কমাতে হবে। সে লক্ষ্যে ওপেকের সদস্যসহ ওপেকের বাইরের দেশগুলোকেও তেল উৎপাদন ও সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। ওপেকের মোড়ল বলে পরিচিত সৌদি আরবের ওপর ভার দেওয়া হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদক ও সরবরাহকারী দেশ রাশিয়াকে তেলের উৎপাদন কমাতে রাজি করানোর জন্য। রাশিয়া ওপেকের সদস্য নয়, তাই ওপেকের কোনো সিদ্ধান্ত মানতে সে বাধ্য নয়। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ সালমান (কার্যত তিনিই তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানের পক্ষে দেশ চালান) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সবিনয় অনুরোধ জানান যে রাশিয়া যেন তেল উৎপাদন হ্রাস করে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য পতনকে ঠেকাতে সহযোগিতা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিন সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন যে রাশিয়া তেল উৎপাদন ও সরবরাহ কমাবে না। সৌদি যুবরাজের জন্য এটি ছিল অবমাননাকর। আর এর উত্তরে তিনি জানিয়ে দেন সৌদি আরব বিশ্বে তেলের বন্যা বইয়ে দেবে এবং দেখে নেবে রাশিয়া তেল বিক্রি করে কত লাভবান হতে পারে! সৌদি যুবরাজ তেলের বন্যা ঘটাননি বটে কিন্তু রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে তেলের উৎপাদন বিপুল আকারে বাড়িয়ে দেন। ফলে তেলের মূল্য বিরাট পতনের দিকে যায় এবং এ আশঙ্কা থেকেই যায় যে তেলের মূল্য আরও কমে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে।

কিন্তু তাহলে নাটকের শেষ অংশে কী ঘটল, যা কিনা পুরা ঘটনাটির মধ্যে বিপরীতমুখী এক চক্রান্ত উন্মোচিত করে? আর এখানেই তেল বিশ্লেষকদের গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। একদল বিশ্লেষক বলছেন, প্রকৃতপক্ষে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ সালমান ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিবাদ ছিল পাতানো খেলা। আর এ খেলাটি তাঁরা খেলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কাবু করার লক্ষ্যে। বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেল উৎপাদনের একটি অসনাতনী প্রযুক্তির মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর যাবৎ প্রচুর তেল উৎপাদন করে, যেটি ‘শেল অয়েল’ নামে পরিচিত। এই প্রযুক্তি সৌদি আরব বা রাশিয়া কাজে লাগাতে পারে না বা করে না। আর এই পদ্ধতির মাধ্যমে বাড়তি তেল উৎপাদন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও রাশিয়া উভয়কেই পেছনে ফেলে বিশ্বের সর্বোচ্চ তেল উৎপাদক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর এখানেই সৌদি আরব ও রাশিয়ার গাত্রদাহ। এ তথ্য সবার জানা যে শেল অয়েল উৎপাদন অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল। অর্থাৎ বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেল অয়েল উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে লাভ করতে পারবে না। আর এটিই ছিল নাটকের শেষ অংশের ষড়যন্ত্রের মূল কারণ। রাশিয়া ও সৌদি আরব উভয়েই চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেল অয়েল উৎপাদন বন্ধ হোক ও তারা আবার তেল উৎপাদনের শীর্ষ দুটি দেশ হিসেবে তাদের অবস্থান ও গর্ব ফিরে পাক। আর করোনাভাইরাস তেলের মূল্যের পতন ঘটিয়ে নাটকটি উপস্থাপন করার যে সুযোগ করে দেয়, সৌদি আরব ও রাশিয়া তা পুরো মাত্রায় কাজে লাগায়। অন্তত এক পক্ষ বিশ্লেষক তা-ই মনে করে থাকেন।

তেলের মূল্য বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তেলের মূল্য পতনে তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশগুলো তাদের ঈপ্সিত রাজস্ব অর্জনে ব্যর্থ হয়, যার ফলে অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনার কারণে তেলের দরপতনের ফলে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ রাজস্ব হারাবে। আর এর ফলে সেসব দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হবে। আবার অন্যদিকে তেলের মূল্যহ্রাস স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তেল আমদানির খরচ কমানোর সুবাতাস বয়ে আনে।

বাংলাদেশ শতভাগ তেল আমদানিকারক দেশ। এ দেশে বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ টন তেল আমদানি করা হয়, আর এর জন্য বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এ খরচের পরিমাণ বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বাড়া-কমার ওপর বাড়ে বা কমে, যাতে নিকট অতীতে ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের বেশি ওঠা থেকে ৩০ ডলারের নিচে নামার দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করা যায়। তেলের মূল্যহ্রাস বা বৃদ্ধি কখনো বা যুদ্ধবিগ্রহ, কখনোবা অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তথা বৈশ্বিক নানান ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেবল তা-ই নয়, বরং মূল্যহ্রাস বা বৃদ্ধির আকস্মিকতা কখনোবা বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে থাকে। আর তেলের মূল্যে এহেন ঊর্ধ্বমুখী ঝাঁকুনি তেল আমদানিকারক দেশ, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বিড়ম্বনা বয়ে আনে, তা বলাই বাহুল্য। তাই তেলের মূল্য যখন সর্বনিম্নমুখী, তখন তেলের বাড়তি মজুত জড়ো করে রাখা বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। এমন স্ট্র্যাটেজিক মজুত জড়ো করে রাখার উদাহরণ কোনো কোনো দেশে লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানি করা তেলের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। দেশে আপত্কালীন সময়ের জন্য স্ট্র্যাটেজিক মজুত জড়ো করার এখনই সর্বোত্তম সময় বিবেচিত হতে পারে।

বদরূল ইমাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক