বিশ্বসভায় বিশেষ মর্যাদায় বাংলাদেশ
বিজয়ের ৪৮তম বার্ষিকীতে আমাদের জন্য এটা অসামান্য উৎসাহের বিষয় যে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে শির উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ত্যাগ ও দাম দিয়ে আমাদের বিজয় পেতে হয়েছে। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন লাখো নারী। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়েছে এ দেশের সাধারণ মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল দেশটি। এত কিছুর বিনিময়ে পাওয়া বিজয়ের পরও আমাদের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, শূন্যতা ও আশাভঙ্গের বেদনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে ছাপিয়ে, বাংলাদেশ অর্থনীতি ও মানবসম্পদের উন্নয়ন এবং সংকট উত্তরণের একটা পর্যায়ে আছে, বিশ্ব যাকে সমীহ করে। অনেক অর্থনীতিবিদ নিশ্চিতভাবেই, বাংলাদেশকে পরবর্তী এশীয় বাঘ হিসেবে দেখছেন।
গত এক দশকে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ সাফল্য ধরে রেখেছে বিদেশনীতিতে। আমাদের অগ্রগতি ও উন্নয়ন নিঃসন্দেহে বিশাল ও আশাব্যঞ্জক, কিন্তু সুশাসন, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ অবশ্যই সন্তুষ্টি দাবি করতে পারে না। তবে আমাদের এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত, এটাও একটা শক্তি। বাংলাদেশকে কোথায় প্রতিকার বিধান করতে হবে, সেটা তার জানা। মানুষ তাই স্বপ্ন দেখে। এখন বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক জাতিই তুলনা করে। তারা বলে বাংলাদেশ সংকটে থেকেও যা পারে, আমরা পারি না কেন।
২০১৮ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭.৮ ভাগ, যখন ভারত ও পাকিস্তানের থেকেছে যথাক্রমে ৮ এবং সাড়ে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু ঋণ যখন ৪৩৪ মার্কিন ডলার, তখন পাকিস্তানের দ্বিগুণের বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তানের চেয়ে চার গুণ বেশি। ১৯৭১ সালে আমাদের রপ্তানি ছিল শূন্য। শুধু তা-ই নয়, আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত ছিলাম। আমাদের সম্পদ লুটে তারা অনেক এগিয়ে ছিল। সেই পাকিস্তানের রপ্তানি আজ ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের নিচে। আমাদেরটা ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি, আর আমরা ৫ হাজার কোটি ডলারের যে লক্ষ্য স্থির করেছি, সেটাকে কেউ আর আগের মতো অকারণে উচ্চাভিলাষী বলে নাকচ করছে না।
আইএমএফ হিসাব করে দেখেছে, আমাদের অর্থনীতি ১৮০ বিলিয়ন ডলারের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সেটা ৩২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ১৯৫১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লাখ। পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ। কিন্তু আজ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানিরা হয়েছে ২০ কোটি। আয়ুষ্কালে পাকিস্তানিদের চেয়ে এখন বাংলাদেশিরা ছয় বছর বেশি বাঁচে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। বেড়েছে গড় আয়ু। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও বলেছে, পাকিস্তানি নারীদের ২৫ ভাগ চাকরিতে, বাংলাদেশ ৬ শতাংশের বেশি।
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ডন-এর পাকিস্তানি একজন ভাষ্যকার সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন, আমরা ছেলেবেলা থেকেই জেনেছি যে বাঙালিরা খর্বকায়, তাদের গায়ের রং কালো, তারা খুব ভালো কিছু জিনিস তৈরি করতে পারে না। পারে শুধু পাট ও ধান ফলাতে। আর পারে মাছ ধরতে। পূর্ব পাকিস্তানকে হারিয়েও যখন আমরা পাকিস্তান নাম রেখেছিলাম, তখন শাসকেরা ভেবেছিল যে তারা অর্থনৈতিকভাবে টিকতে পারবে না। তারা সুড়সুড় করে পুনরায় ফিরে আসবে। ডন-এর এই লেখকের সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি, কারণ আমরা তার কথার সমর্থক কিছু ষড়যন্ত্রের তথ্য জানি। আমরা বিশ্বাসযোগ্য সূত্রগুলোতে প্রমাণ পাই, পাকিস্তানি শাসকেরা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা হত্যা করেছিল, তারা আসলে বড় রকমের একটা হতাশা থেকেই করেছিল। হয়তো ভেবেছিল তাকে ধ্বংস করলে একটা ‘অর্জন’ সম্ভব হতে পারে। কিন্তু শত ঝড়-ঝঞ্ঝা, আত্মঘাতী, ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি, সামরিক অভ্যুত্থান, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের প্রতি ঝোঁক এবং আইনের শাসন থেকে ছিটকে পড়া ও থাকার ঝুঁকির মধ্যে আজ বিজয়ের এই দিনে আমরা একটু আবেগে আপ্লুত থাকতে চাই। আমাদের অসাধারণ অর্জনগুলো পুরো জাতির।
আজ শপথের দিন। আজ আত্মজিজ্ঞাসার দিন। আজ ভুলত্রুটি শোধরানো আর রাজনৈতিক সমস্যাকে শুধু সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনীতির নীতি দিয়েই মোকাবিলা করার শপথের দিন। আমাদের অবশ্যই যুগোপযোগী রাজনৈতিক ও শাসনগত সংস্কারে যেতে হবে। ভারত উপমহাদেশের দিকে তাকালে মনে হয়, ৪৮ তম বিজয়ের বার্ষিকী বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক নেতৃত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করার একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প প্রতিহত করেই এসেছে বাংলাদেশ।
দ্বিজাতি তত্ত্বের গরল নিয়ে দেশভাগ হয়েছিল। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করার একটি দৃপ্ত ও জীবন্ত অঙ্গীকার। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ঐতিহ্যগত গর্ব ধুলোয় মিশে গেছে, এ কথা ভারতের স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী শক্তিগুলোর উচ্চারণে আজ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের সামনে তাই আরও বড় চ্যালেঞ্জ, তাকে অসাম্প্রদায়িক এবং বহুত্ববাদের সব শর্ত মেনেই টিকে থাকতে হবে। যে রাজনীতি বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করেছে, যেখানে সব মানুষের অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তির উপাদান থাকবে। নির্বাচন ও গণতন্ত্র বাংলাদেশের শিরায় শিরায় নাচে। সেই পরম সত্য ও বাস্তবতাকে যাতে আমরা না ভুলি। এমন কোনো উন্নয়ন হতে পারে না, যার সঙ্গে আমরা স্বাধীনতার মূল চেতনার সওদা করতে পারি। এটা অবশ্যই দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
আমরা বিবাদ-বিসম্বাদের মধ্যে কোথায় একটু সংযম, পরিমিতিবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, উদারনৈতিকতার উপাদান আছে, সেসবকে আমরা বড় করেই দেখতে চাই। প্রধান বিরোধী দলের নেতার জামিন হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তিনি আবার এখন কারাগারেও থাকছেন না। আমরা বিশ্বাস করি, আপস ও সমঝোতার একটা জায়গা রাজনীতি থেকে উবে যায়নি। একটা আপসরফার জায়গা রাজনীতিতে রাখতে হবে। সেটাই মস্ত চ্যালেঞ্জ মনে হয়।
কখনো মনে হয়, গত চার দশকের বেশি সময়ে আমরা জাতীয় রাজনীতিতে একেবারে ধসে পড়ার দ্বারপ্রাপ্ত থেকে বারবার ফিরে এসেছি। আমরা বিশ্বাস করি একটি বহুত্ববাদী, বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ, যেখানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকেও আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে পারব। এই রকম একটি পথেই প্রত্যাশিত স্থিতি, শান্তি ও পরিবর্তন আসবে।
বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশ একই সঙ্গে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি রক্ষা করে যাচ্ছে। আমরা অসাধারণ কূটনীতি দিয়ে সমুদ্র জয় এবং আলোচনা করেই গোটা স্থলসীমান্তের সীমা নির্ধারণ সম্পন্ন করতে পেরেছি। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দান এবং তাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করার কূটনীতিতে বাংলাদেশ সক্রিয় রয়েছে। একাত্তরে আমরা নিজেরাই গণহত্যার শিকার হয়েছিলাম, আন্তর্জাতিক আদালতে যার বিচার পাইনি। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, জাপান ও ভারত বিশ্বমঞ্চে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা টানাপোড়েনপূর্ণ একটা সম্পর্কে রয়েছে। এটা অবশ্যই স্বস্তির যে এই সব কটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি ধরে রাখা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
তাই কাউকে পিছিয়ে ফেলে নয়, একটি জাতিরাষ্ট্রের শক্তির মূল উৎস অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সবকিছু, সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব, এই হিরণ্ময় অভিপ্রায়ের উদ্বোধন ঘটুক—এই প্রার্থনা করি। বিজয়ের আনন্দ তাই ভাগাভাগি করে নেওয়ারও অধিকার সবার। সব মত, পথ, বর্ণ, গোত্রের মানুষের জীবনে এই ভূখণ্ডে প্রতিবছরই আশা ও সম্ভাবনা নিয়ে নেমে আসুক বিজয় ও গর্বের ফল্গুধারা।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com