Thank you for trying Sticky AMP!!

বিশ্বায়ন পাল্টা আঘাত হেনেছে

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত জার্মানি।

মোটাদাগে ২০২১ সালের গরমকালকে চিহ্নিত করতে পারা যায় দুটি বিষয় দিয়ে। তা হচ্ছে চলমান কোভিড-১৯ মহামারি এবং দ্রুত বাড়তে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন। দুটিই বিশ্বায়নের প্রকাশ। বিশ্বের এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে সীমানা অতিক্রম করে আক্ষরিক অর্থেই সবকিছুর বিপুল ও দ্রুত প্রবাহ। জিনিসপত্র, সেবা, পুঁজি থেকে তথ্য, সন্ত্রাসবাদ এবং রোগব্যাধি, যা-ই হোক না কেন।

এখন কোনো কিছুই আর স্থানীয় বিষয় হয়ে থাকছে না। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস চীনের উহানে প্রথম উৎপত্তি হলেও সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। একইভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস বিশ্বের যে প্রান্তেই নিঃসরণ হোক না কেন, তা বায়ুমণ্ডল ও সমুদ্রের সব জায়গাকেই উষ্ণ করে তুলছে।

বিশ্বায়ন থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এখানে একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বায়ন ব্যবস্থাপনার কোন উপায় আমরা বেছে নেব

এই দুটি সংকটই একটা জিনিস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আর তা হলো বিশ্বায়নের সমস্যাজনক দিকগুলো সমাধানের জন্য প্রচেষ্টাগুলো কত অপর্যাপ্ত ও হতাশাজনক। তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবারও প্রমাণ করল, তারা নিছক একটা সম্প্রদায় ছাড়া কিছু নয়। কোভিড টিকা সরবরাহ যতটা প্রয়োজন, তার থেকে শত শত কোটি ডোজ পেছনে পড়ে রয়েছি আমরা। একইভাবে বৈশ্বিক টিকাকরণের জন্য যে তহবিল, সেখানেও বিপুল অর্থের ঘাটতি রয়েছে। সরকারগুলো তাদের নিজের দেশের জনগণকে আগে টিকা দেওয়ার নীতি নিয়েছে। যদিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ভেরিয়েন্টগুলোর উৎপত্তি হচ্ছে অন্য কোথাও টিকা কম পাওয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে। রাজনৈতিক সীমানা সেটা মানছে না।

করোনায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪০ লাখে গিয়ে ঠেকেছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টিং ব্যবস্থার কারণে অনেক মৃত্যুর তথ্যই আসছে না। ব্রাজিল, ভারত, হাঙ্গেরি, রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশের লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের তৈরি করা বাধার কারণেও অনেক মৃত্যু হিসাবের মধ্যে আসছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একইভাবে স্থবিরতা এসেছে। মহামারিতে বৈশ্বিক জিডিপি ৩ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। গড়পড়তা ১০ কোটি মানুষ আবার চরম দারিদ্র্যে পড়েছে। দেশের ভেতরে এবং এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বৈষম্য বেড়েছে।

কোভিড মোকাবিলায় কী করা উচিত, তা আমরা জানি। সেটা করার রসদও আমাদের কাছে আছে। এরপরও এমন অবস্থা দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। অনেকগুলো নিরাপদ এবং কার্যকরী টিকা আমাদের হাতে রয়েছে। এখন তাহলে কী করার বাকি? বৈশ্বিক চাহিদা মেটানোর জন্য আনুপাতিক হারে টিকা উৎপাদন বাড়াতে হবে।

অন্য আরেকটি সংকট জলবায়ু পরিবর্তন। ধারণার চেয়েও দ্রুত সামনে এসে হাজির হয়েছে সেটি। এ ক্ষেত্রে বহু বছর ধরে একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো এই ত্রাস ঠেকানোর জন্য কোনো সমন্বিত কর্মকাণ্ড নেই। যদিও পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছে, তা নিয়ে স্পষ্ট ও ক্রমবর্ধমান তথ্যপ্রমাণ ছিল। অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ভিড়ে এই জরুরি বিষয়ই তালিকা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের গরমকাল আমাদের দেখিয়ে দিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক। যুক্তরাষ্ট্রে তাপমাত্রার পারদ চড়ে যাওয়ায় দক্ষিণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া দাবানল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ধোঁয়াশার চাদর মুড়িয়ে দিয়েছে দেশটিকে। ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে ইউরোপ ও চীন। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি খরার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তুলনামূলকভাবে জীবনহানি এখনো কম। কিন্তু যেকোনো সময় তা অনেক বেড়ে যেতে পারে। একইভাবে অর্থনৈতিক অভিঘাতের চূড়া পাহাড় ছুঁতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন থামানো বা এর গতিকে ধীর করে দেওয়ার জন্য অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসছে নভেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত হবে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (কপ–২৬)। এই সম্মেলনেও আগের ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। আলাদাভাবে প্রতিটি দেশ এমন একটা পথ বের করার ওপর জোর দেবে, যাতে করে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিশ্রুতি তারা দিতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভালো চুক্তি এরই মধ্যে হয়ে গেছে। গ্লাসগোতে যেসব সিদ্ধান্ত হবে, তা সত্ত্বেও ভবিষ্যতে আরও চুক্তি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিদ্যমান অথবা অনিবার্য প্রভাব গ্রহণ করার জন্য নগর ও গ্রামাঞ্চলগুলোকে আরও উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

পরিশেষে, যেসব প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড অপসারণ করে অথবা পৃথিবী থেকে দূরে সূর্যালোকের প্রতিফলন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, সেসব নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণ ত্বরান্বিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার এ ধরনের সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি এখনো অপ্রমাণিত ও তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু কোভিড মোকাবিলায় আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতাকে যদি কোনো সূচক হিসেবে ধরি, তাহলে দেরি না করে সেই সূচকগুলো তাড়াতাড়ি ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হওয়াটাই ভালো। বিশ্বায়ন থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এখানে একমাত্র প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশ্বায়ন ব্যবস্থাপনার কোন উপায় আমরা বেছে নেব।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

রিচার্ড এন হাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কাউন্সিলের সভাপতি