Thank you for trying Sticky AMP!!

বিসিএসের প্রতি মোহ আর দুর্নীতিতে আগ্রহ এক নয়

কিছুদিন আগে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর কয়েকটি বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এত অধিকসংখ্যক ছাত্রছাত্রী কেন বিসিএস চাকরির জন্য আবেদন করে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা কেন সাধারণ ক্যাডার পদে ঢুকছে, বেসরকারি চাকরি কিংবা গবেষণার দিকে মেধাবী ছেলেমেয়েরা কেন আকৃষ্ট হচ্ছে না ইত্যাদি। অনেক লেখালেখি ও মন্তব্যের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ পর্যায়ের আমলা ও একজন সুপরিচিত শ্রদ্ধেয় বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকের মতামতের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি অনলাইন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতির ব্যাপকতাই বিসিএসের প্রতি মোহ তৈরি করেছে…প্রশাসনের কর্তারা জানেন দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়।’ তবে তিনি এও বলেছেন, ‘সবাই হয়তো দুর্নীতি করেন না।’ তাঁর মতে, ‘বিসিএস পরীক্ষায় কেন এত মোহ, এ প্রশ্ন গণমাধ্যমের তোলা উচিত। উত্তরও বের করতে হবে। তাহলেই দেখবেন মোহ কেটে যাবে। তখন এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই বিজ্ঞানী, গবেষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হবে।’

‘দুর্নীতির ব্যাপকতাই বিসিএসের প্রতি মোহ তৈরি করেছে’, এ মন্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। এ মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বোঝানো হয়েছে, বিসিএস চাকরিতে ঢুকে অবাধে দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে এবং এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ধনসম্পদের অধিকারী হওয়ার জন্যই মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাও বিসিএস পরীক্ষার দিকে ঝুঁকছে।

আগে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি ক্যাডারভুক্ত ছিল না। ১৯৮২ সনে ক্যাডার সার্ভিস প্রথা প্রবর্তনের পর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক প্রভৃতি পেশাজীবীর চাকরিও ক্যাডারভুক্ত করা হয়েছে। তবে সার্ভিসের পদবিন্যাসের কারণে সব ক্যাডার থেকে যুগ্ম সচিব-সচিব হওয়ার পথটি এক রকম নয়। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য এসব পদ সরাসরি ক্যাডার পদের মতো। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডার থেকে ‘বিশেষ’ সুযোগের মাধ্যমে এসব পদে আসতে হয়। একজন ইঞ্জিনিয়ার পিডব্লিউডি, সড়ক ও জনপথ বা অনুরূপ ডিপার্টমেন্টে চাকরিতে ঢুকে যখন নির্বাহী প্রকৌশলী হন, তখন দেখা যায় একই ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের সহকর্মী যুগ্ম সচিব হয়ে গেছেন।

অন্যদিকে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তার হওয়ার পর একজন চাকুরেকে প্রথমেই মেডিকেল অফিসার হিসেবে উপজেলা বা গ্রামে যেতে হয়। মেধা ও যোগ্যতার বলে যাঁরা সরকারি মেডিকেল কলেজে লেকচারার হিসেবে সুযোগ পান, তাঁরা পরবর্তী সময়ে সহযোগী অধ্যাপক কিংবা অধ্যাপক হতে পারেন। একজন সিনিয়র অধ্যাপক ডাক্তার শেষ বয়সে হয়তো অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদা পান। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টগুলোতেও শীর্ষ পদটি থাকে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার। অন্যান্য ক্যাডারে গ্রেড-১ পদ থাকলে সচিব পদের বেতন পাওয়া গেলেও সচিবের মর্যাদা পান না। কলেজশিক্ষকদের পদোন্নতির অবস্থা আরও জটিল। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে সব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিসিএসে প্রথম-দ্বিতীয় প্রভৃতি পছন্দক্রম হিসেবে প্রশাসন, ফরেন সার্ভিস, পুলিশ, অডিট-অ্যাকাউন্টস, কাস্টমস-ট্যাক্স প্রভৃতি ক্যাডার দেওয়ার পর শেষের দিকে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল বা শিক্ষা ক্যাডার পদের ‘পছন্দ’ দিয়ে থাকে। ক্যাডার-বৈষম্য দূরীভূত না হলে ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তারদের স্ব-স্ব পেশার চাকরি গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না।

একটি বিষয় সবারই জানা, আজকাল সরকারি চাকরিতে যেমন নিরাপত্তা, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি, সম্মান ও অন্যান্য বাস্তব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, বেসরকারি চাকরিতে তেমনটি নেই। বিদেশি ব্যাংক কিংবা বহুজাতিক কোম্পানিতে পদের সংখ্যার সীমাবদ্ধতা ও চাকরির শর্তাবলির কারণে এসব চাকরি আজকাল আর তেমন আকর্ষণীয় নয়। বেসরকারি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের অধীনে চাকরির নিশ্চয়তা যেমন কম, বেতনও যথেষ্ট নয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা গবেষণা সংস্থাগুলোর বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও এখন আর মেধাবীদের আকর্ষণ করতে পারে না।

‘দুর্নীতির ব্যাপকতাই বিসিএসের প্রতি মোহ তৈরি করেছে’, এ মন্তব্য কতটা যৌক্তিক ও সম্মানজনক? সরকারি অফিস ছাড়া দেশে আর কোথাও কি দুর্নীতি নেই? সরকারি অফিসে দুর্নীতিবাজ কর্মচারী যেমন রয়েছেন, দুর্নীতি না করে সৎ জীবন যাপন করেন, এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছেন ভূরি ভূরি। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশের অগ্রগতির জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারব্যবস্থা টিকে আছে। নিঃসন্দেহে সরকারের সহায়তাকারী হিসেবে আমলাতন্ত্রের অর্থাৎ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকা প্রয়োজন। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমেই এরূপ কর্মকর্তা নির্বাচন করা হয়ে থাকে।

সরকারি কাজ হবে জনস্বার্থে এবং জনসেবামূলক। কিন্তু জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে, পদে পদে সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি করা হলে, কীভাবে জনসেবা হবে? একটা কথা আমরা মনে রাখি না যে, এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এখন সরকারি চাকরি করে বেতন পাই। ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনসাধারণের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণে জনদুর্ভোগ বাড়ে। এক শ্রেণির কর্মচারী ও সেবা গ্রহীতার ঘুষ গ্রহণ ও প্রদানের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে কাজের জন্য ঘুষ আদান-প্রদান হয়, সেখানে উভয় পক্ষের ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পায়, সরকার বা দেশের স্বার্থ প্রত্যাখ্যাত হয়।

দুর্নীতি দমন কিংবা প্রতিরোধের জন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিংবা রয়েছে বিচারালয়। সেসব জায়গায় যদি সততা ও নৈতিকতার ঘাটতি থাকে, তাহলে দুর্নীত প্রতিরোধ এবং ন্যায়বিচার কীভাবে হবে? শুধু সরকারি চাকরিতেই নয়, সততা ও নৈতিক সু-আচরণ আমাদের জীবনের সর্বত্রই অত্যাবশ্যক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্প উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান—সব জায়গায় ভালো ও অসৎ দুই মানুষই রয়েছেন। এক শ্রেণির শিক্ষক যে কী পরিমাণ অসৎ ও নীতিহীন, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুবাদে দেখেছি। বহু নীতিহীন ঠগবাজ, স্বার্থপর উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের দেখার সুযোগ হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনবিআরে কাজ করার সুবাদে।

ব্যাংকের টাকা লুটপাট, ঋণ গ্রহণের নামে অর্থ আত্মসাৎ, বিদেশে অর্থ পাচার, ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হওয়া এখন দেশে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিচারব্যবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা প্রদান, মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দেওয়া, অনৈতিকভাবে কাউকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা, অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া—এসব ঘটনাও হরহামেশা শোনা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিও নতুন কিছু নয়।

অনেকের মতে, বিভিন্ন সময় বিদেশি শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়া এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলে স্বৈরাচারী শক্তির ক্ষমতা দখলও দেশে দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম কারণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজ করার সুবাদে দেখেছি, দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ২২ লাখ মানুষ সরাসরি আয়কর দেন। আয়করদাতা ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানেরও অনেকে প্রদেয় করের চেয়ে কম আয়কর পরিশোধ করেন। বহু ব্যবসায়ী সঠিক ভ্যাট প্রদান করেন না। আয়কর ও ভ্যাট সংগ্রহকারীরাও ঘুষ নিয়ে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তা করেন। আয়কর প্রদানে যোগ্য সবাই আয়কর দিলে এবং কর ফাঁকি রোধ করা গেলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হতো।

এত কিছুর মধ্যেও সৎ, নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী, সত্যবাদী, দেশপ্রেমিক মানুষের সংখ্যাও অনেক। সে জন্য দুর্নীতির ব্যাপকতার জন্য শুধু সরকারি কর্মকর্তা কিংবা কোনো বিশেষ শ্রেণিকে দোষারোপ করা যাবে না। তারা এ দেশের, এ সমাজেরই একটা অংশ। দেশের মানুষের মধ্য থেকে নীতি-নৈতিকতা যখন উঠে যায়, তখনই দুর্নীতি জেঁকে বসে। শুধু ঘুষ গ্রহণই দুর্নীতি নয়, ঘুষ দুর্নীতির একটি অংশ মাত্র।

দেশে আইনের শাসনের ঘাটতি হলেও দুর্নীতি বাড়ে বলে অনেকে মনে করেন। সরকার এবং দেশ ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কর্তব্য হওয়া উচিত আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগ্য ব্যক্তি পদায়ন করে এগুলোতে সততা ও নিরপেক্ষতার লালন করা। সব সরকারি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সংগঠন ও সব সাংবিধানিক ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠান ও কমিশন থেকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি উপড়ে ফেলা এখন সময়ের দাবি। সুশাসন ও আইনের শাসনই হলো দুর্নীতি দমনের চাবিকাঠি।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।