Thank you for trying Sticky AMP!!

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড: বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটেছে

>

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২,২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর দুই পলাতক আসামি আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ওই দুই কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ ১৭ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনো আপিল করেননি। এই মামলার শুনানিতে সাক্ষীদের ভাষ্যে অনেক অজানা মর্মস্পর্শী তথ্য ও বিষয় উদ্‌ঘাটিত হয়। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নথিপত্রের ভিত্তিতে কিছু বিষয় নির্বাচিত করেছেন। এর সবটাই মূলত শহীদদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি। ৫ কিস্তির এই নির্বাচিত অংশের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ।

প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি পালন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির জন্য এটি বেদনাবৃত একটি কালো দিন। সুসংগঠিত পরিকল্পনায় ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর দেশীয় দোসর আলবদররা।

৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সুসংগঠিতভাবে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যাসহ এই বুদ্ধিজীবীদের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে আসছিল জাতি। এ লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তায় প্রণীত হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩। কিন্তু ১৯৭৫–এর আগস্টে সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসকদের দৃশ্যমান অনুমোদনে শুরু হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অসীম বেদনা বুকে নিয়ে জাতি হতে থাকে রক্তাক্ত। ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনটি নীরব থেকে যায়।

অবশেষে বিচারহীনতার গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করার সাহসী উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ এর মার্চে গঠিত হয় আরেকটি ট্রাইব্যুনাল। শুরু হয় শীর্ষস্থানীয় রাজাকার, আলবদর এবং পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর শক্তিধর দোসরদের বিচারকাজ। বিচার শুরু হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের। বিচারকার্য সম্পন্ন করে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের’ মূল নায়ক আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী খান এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে এই রায়সহ ঘোষিত সব রায়ই আপলোড করা আছে।

দেখা যায়, এই মামলায় ১১টি চার্জ গঠন করা হয়। ২৫ জন সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্য ও দালিলিক সাক্ষ্য তথা তথ্যনির্ভর সমসাময়িক দেশি–বিদেশি পত্রপত্রিকার রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রতিটি চার্জেই এই দুই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

এ ধরনের বর্বর প্রকৃতির আন্তর্জাতিক অপরাধসংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড প্রদানই একমাত্র লক্ষ্য নয়। এই প্রকৃতির মামলার রায়ের মাধ্যমে জাতি বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে কী অসীম রক্তস্নাত আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, পেয়েছি প্রিয় মাতৃভূমি ‘বাংলাদেশ’। আর এই নির্মম প্রতিষ্ঠিত সত্যই নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনা বুকে ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। একই সঙ্গে বিশ্বও জানবে এসব সত্য। আর এই সত্যের অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় শহীদদের স্বজনদের বুকে জমে থাকা ক্ষত ও নিরন্তর কান্নাকে তাঁদের ভাষায় তুলে ধরার প্রয়াসেই এই লেখা।

বিচারকেরা তাঁদের রায়ে উল্লেখ করেছেন—বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর অংশ। এই হত্যাকাণ্ড প্রকারান্তরে একটি জাতিকে নির্মূলের জন্য পরিকল্পিত ম্যাসাকার। এটি ছিল জাতিকে মেধাশূন্য করার এক নীলনকশা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে এ মামলায় মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি।

এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির হৃদয়ে অবর্ণনীয় এক যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন। আইনের অক্ষর এখানে নির্বিকার থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অপরাধের প্রকৃতি, মাত্রা ও গভীরতার বিচারে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ন্যায়বিচার করা হবে। ট্রাইব্যুনাল-২ প্রদত্ত রায়ে এসব পর্যবেক্ষণ দেন। তখন আমি ছিলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২–এর চেয়ারম্যান। আমার সঙ্গে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অপর দুই সদস্য বিচারক ছিলেন ব্রাদার জাজ মাননীয় বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া (বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত) এবং মাননীয় বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম, (বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান)।

যেহেতু অভিযুক্ত দুজনই পলাতক ছিলেন, তাই আইনের বিধান অনুযায়ী তাঁদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী নিয়োগের জন্য দুজন দক্ষ আইনজীবীর নাম সরকারের কাছে পাঠাই এবং আমাদের মনোনীত আইনজীবীদের সরকার মামলাটি পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী বা স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। মামলাটি ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন’ এই নামে নামাঙ্কিত হয়।

যেকোনো অপরাধসংশ্লিষ্ট মামলার রায় প্রদান করতে গিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়। এই সাক্ষ্য এবং পারিপার্শ্বিক আরও অন্যান্য সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করা হয়। যৌক্তিকভাবে এসবের বিশ্লেষণ করা হয়। এভাবেই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়। আর এটি করতে গিয়ে রায়ে সাক্ষীদের সবটুকু বক্তব্য আলোচনায় আসে না। কেবল প্রদত্ত বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশটুকুই তুলে ধরা হয়। এ মামলার রায় প্রচারিত হয়েছে আজ থেকে ছয় বছর আগে।

রায়টির সারাংশ এবং ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ তখনকার দেশি–বিদেশি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ রায়টি সংশ্লিষ্ট নথিতে ট্রাইব্যুনালে সংরক্ষিত আছে। যেহেতু দণ্ডিত দুজন আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণের পর এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে কোনো আপিল দায়ের করেননি, তাই বিষয়টি আর সাবজুডিস বা বিচারাধীন নয়। এটি এখন একটি পাবলিক ডকুমেন্ট বা গণদলিল। ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে এবং আইসিসি লিগ্যাল টুলস প্রজেক্টের ওয়েবসাইটেও তা আপলোডেড রয়েছে। যে কেউ চাইলেই এই রায় সেখান থেকে পেতে পারেন, পড়তে পারেন।

যেহেতু এ মামলার রায় ও সাক্ষ্য সবই এখন পাবলিক ডকুমেন্ট, সেহেতু আমি ভাবলাম মহান বিজয়ের এই মাসে দেশের মানুষের জানার অধিকার আছে। বিশেষ করে এই মামলার সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানোর বেদনা ব্যক্ত করতে গিয়ে কী বলে গেছেন। এই সাক্ষীদের মধ্যে অনেকেই শহীদদের সন্তান বা নিকটাত্মীয় এবং তাঁদের স্বজন ও কাছের মানুষ। এই মামলার সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যে কথাগুলো বলে গেছেন, তা সবই বলেছিলেন বাংলায় এবং সেভাবেই তা লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু রায় যেহেতু ইংরেজিতে লেখা, সেহেতু সংগত কারণেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেই তা রায়ে তুলে ধরা হয়েছে।

রায় প্রদানের মাধ্যমে যে সত্য, জাতির যে আত্মত্যাগের বিষয়টি বেরিয়ে আসে, তা তাদের কাছে ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই ইংরেজিতে রায় লেখার প্রয়াস। সাক্ষীদের আবেগের কথা রায়ে সামান্যই উল্লেখ আছে। কেননা, রায়ে এর সবটুকু প্রতিফলিত করা বেশ কঠিন।

সাক্ষীদের সাক্ষ্যের সবটুকু তুলে না ধরে এর উল্লেখযোগ্য অংশ (কিছু কিছু বানান শুদ্ধকরণসহ) পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি।

সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন অপহরণ ও হত্যা

এই অভিযোগের সমর্থনে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন মাত্র তিন বছরের শিশু। বড় হয়ে তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা শুনেছেন।

সাক্ষী তৌহীদ রেজা নূর ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ:

 ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল তিন বছর। ওই বয়সেই আমি আমার বাবাকে হারাই। আমরা আট ভাই, আমাদের কোনো বোন নেই। আমি ভাইদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ১৯৭১ সালে আমার বাবাকে কীভাবে অপহরণ করা হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তীতে আমার মা এবং আমার মেজ ভাই শাহীন রেজা নূরের কাছ থেকে শুনেছি এবং জেনেছি।

‘১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক–এ “এত দিনে” শিরোনামে একটি লেখা বের হয়, যেখানে আমার বাবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের অবস্থান সম্পর্কে সমালোচনা করেন। সে সময় আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাক–এর বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।

‘১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকায় ব্ল্যাক আউট চলছিল। মধ্যরাত ১২টা-সাড়ে ১২টার দিকে আমাদের বাসার দরজায় করাঘাত হয়। এই শব্দে আমার বাবা-মাসহ অন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে যখন আমার বাবা দরজা খোলেন তখন সেখানে কাউকে দেখতে পাননি। এই অবস্থায় আমার বাবা দরজা বন্ধ করে তিনিসহ সবাই ঘরে শুতে যান। এরপর রাত ৩টা–সাড়ে ৩টার দিকে আবার দরজায় করাঘাতের শব্দ শোনা যায়। আমার মেজ ভাই শাহীন রেজা নূর ঘুম থেকে উঠে শুনতে পান বাড়িওয়ালা তাঁকে ডেকে বলছেন “শাহীন দরজা খোলো”। এই অবস্থায় আমার ভাই দরজা খুলে দেখতে পান বাড়িওয়ালা, তাঁর দুই ছেলে এবং তাঁর শ্যালকেরা গান পয়েন্টে দরজার বাইরে দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি আরও দেখতে পান ছয়-সাতজন সশস্ত্র লোক কেউ মাফলার, কেউ মাংকি ক্যাপ বা অন্য ধরনের কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আধো বাংলা আধো উর্দুতে জানতে চায় ঘরে কে আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ জোরপূর্বক আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকে বাবার শোয়ার ঘরের সামনে চলে আসে। আমার মা সে সময় কী হয়েছে জানার জন্য সামনে এগিয়ে এসে শোয়ার ঘরের দরজাটি খোলেন। এই অবস্থায় সশস্ত্র লোকগুলো আমার বাবার শোয়ার ঘরে ঢুকে যায় এবং আমার বাবাকে লক্ষ করে বলে “হ্যান্ডস আপ”। তখন আমার বাবা লুঙ্গি–গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় আলনার দিকে যাচ্ছিলেন সেখান থেকে একটি পাঞ্জাবি নিয়ে গায়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু তা পারেননি। তার আগেই তাঁকে হাত উঁচু করতে বলা হয়। এই অবস্থায় আমার বাবাকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা ভাঙা ভাঙা উর্দুতে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তিনি তাঁর পরিচয় দিলে ওই লোকগুলো তাদের সঙ্গে বাইরে আসতে বলে এবং বাড়ির লোকদের কাছে একটি গামছা চায়। আমার বাবার পিছে পিছে যারা ঘরের বাইরে এসেছিল, তাদের বন্দুকধারীরা বন্দুকের নলের মুখে ঘরের ভেতরে চলে যেতে বলে। ইতিমধ্যেই আমার মা একটি গামছা বন্দুকধারীদের হাতে তুলে দিয়ে সবাই ঘরের ভেতরে চলে আসে। এরপর বন্দুকধারী ব্যক্তিরা গামছা দিয়ে আমার বাবার চোখ বেঁধে নগ্ন পায়ে নিয়ে যায়। এটাই ছিল আমার বাবার শেষ যাত্রা।

‘পরবর্তীতে বিজয়ের পরে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ যখন জানা গেল রায়েরবাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর লাশ পড়ে আছে, তখন আমাদের স্বজনেরা সেখানে যান কিন্তু গলিত বিকৃত লাশের মধ্যে আমার বাবার লাশটি শনাক্ত করতে পারেননি।’

সাক্ষী তৌহীদ রেজা নূরের সাক্ষ্য থেকেই উঠে এসেছে বর্বরতার প্রকৃতি। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদের স্বজনদের এ বেদনা জাতি কোনো দিন বিস্মৃত হবে না।

সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হক অপহরণ ও হত্যা

শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল এই মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছর। তিনি বড় হয়ে মা ও পরিবারের মুরব্বিদের কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণের কথা জানতে পেরেছেন। তাঁদের কষ্ট, শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের লাশ পরিবার কখনো খুঁজে পায়নি।

শহীদ সৈয়দ নাজমুল হকের ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তার কিয়দংশ:

 ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে যখন পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, তত্পরবর্তীতে আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দুইবার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আটক রাখা হয় এবং অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও আমার বাবা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় পাকিস্তানিরা তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। ওপরে উল্লেখিত ঘটনাসমূহ আমি আমার মা, আমার প্রয়াত চাচা সাবেক সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দ সাজ্জাদুল হক এবং আমার পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ অন্য সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পারি।

‘আমার মায়ের কাছ থেকে জেনেছি, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত চারটার দিকে আলবদর বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল আমাদের ৯০ নম্বর পুরানা পল্টনের বাসায় এসে দরজা জোরপূর্বক ভেঙে ফেলে এবং ছয়–সাতজনের একটি দল ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন আমার বাবা, মা, আমার এক বোন এবং আমি দোতলার সিঁড়িতে আশ্রয় নিই। এ সময় আলবদররা আমার বাবার নাম ধরে ডাকে। এরা সবাই মুখোশ পরা ছিল। তখন আমার বাবা নিচে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। তখন তারা অস্ত্রের মুখে আমার বাবাকে আটক করে ধরে নিয়ে একটি গাড়িতে তোলে।

‘আমি পরিবারের মুরব্বিদের কাছ থেকে আরও জানতে পারি, বদর বাহিনীর লোকেরা আমার বাবাকে অপহরণের পূর্বে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ও আ ন ম গোলাম মোস্তফা সাহেবকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্যই বদর বাহিনীর সদস্যরা একটি নীলনকশার মাধ্যমে এই সাংবাদিকদের অপহরণ করে।

‘আমরা ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১–এর পর থেকে আমার বাবাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর জল্লাদখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আমার বাবার লাশ পাইনি।’

এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকেও পাওয়া যায় বর্বরতার আরেক চিত্র। বাবাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাবার লাশটিও খুঁজে পাওয়া গেল না। ঘটনার ভয়াবহতা কেবল শহীদের পরিবারকে শোকে মুহ্যমান করেনি; বিশ্বও হয়েছে হতবাক।

সাংবাদিক এ এন এম গোলাম মোস্তফা অপহরণ ও হত্যা

শহীদ গোলাম মোস্তফার ভাই গোলাম রহমান দুলু ছিলেন তাঁর ভাইয়ের অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ২২–২৩ বছর। এই মামলার অপর সাক্ষী শহীদ গোলাম মোস্তফার ছেলে অনির্বাণ মোস্তফা। পেশায় তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ তাঁর জন্ম। বাবার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন ৯ মাসের শিশু।

শহীদ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই সাক্ষী আ ন ম গোলাম রহমান ওরফে দুলু ট্রাইব্যুনালে বলেন:

‘১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই আমরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ঠিক সেদিন ভোর ছয়টার দিকে আমার ভাবির (আ ন ম মোস্তফা সাহেবের স্ত্রী) বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দোহা সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে একটি জিপে কয়েকজন মিলিশিয়া ও আলবদর আমাদের বাসার সামনে এসে থামে।...সেদিন আমার বড় ভাই তাঁর ৯ মাসের বাচ্চা অভিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এরই একপর্যায়ে আগত আলবদর ও মিলিশিয়ারা আমাদের বাসার দরজার কড়া নাড়ে। কড়া নাড়ার শব্দ শুনে আমার ভাই–ই দরজা খুলে দেন। আগত লোকেরা আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করে তিনি আ ন ম গোলাম মোস্তফা কি না। তিনি হ্যাঁ–সূচক জবাব দেন। দুই–তিনজন মুখোশধারী লোক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বাকি বেশ কয়েকজন মিলিশিয়া ছাই রঙের পোশাক পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র হাতে বাইরে অবস্থান করছিল।...আমার বাবা-মাসহ আমরা সকলেই কান্নাকাটি করতে থাকি। আমার বাবাকে আগন্তুকদের একজন সান্ত্বনা দিয়ে বলে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই, আপনার ছেলের পরিচয় নিশ্চিত করেই তিনি ফিরে আসবেন। এ কথা বলে আমার ভাইকে তারা তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।

‘বিজয় অর্জনের পর আমি প্রায় প্রতিদিন রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে শুরু করে ঢাকার আশপাশের প্রায় প্রতিটি বধ্যভূমিতে আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজেছি। লাশ খুঁজতে গিয়ে অনেক অর্ধগলিত লাশ টেনে সরাতে হয়েছে। তখন অনেক লাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা আর আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে পাইনি। আমার ভাইকে আলবদররা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আমার বাবা যে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন, তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি। তিনি ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুবরণ করেছেন।’

সাক্ষী অনির্বাণ মোস্তফা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন:

‘আমার বাবার মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ৯ মাস। আমার মা তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ আমার ছোট বোন ঊর্মি মোস্তফার জন্ম হয়। আমার মা বর্তমানে বেঁচে আছেন।

‘আমি শিশুকাল থেকেই পিতৃহারা হওয়ার কারণে আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার পিতার অপহরণ এবং হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। যেহেতু আমি আমার বাবাকে বাবা বলে সম্বোধন করতে পারিনি, সেহেতু তাঁর ব্যাপারে এবং তাঁর অপহরণকারী যার নাম আমি পরবর্তীতে জেনেছি চৌধুরী মঈনুদ্দীন এই দুজন মানুষের ব্যাপারে আমার জানার আগ্রহ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়।

‘আমি জেনেছি, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাতে আমি সারা রাত ঘুমাইনি। সে কারণে ১১ ডিসেম্বর ভোরবেলা থেকেই আমার বাবা আমাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সেদিন ভোর ছয়টার দিকে একটি জিপে করে কিছু লোক রায়েরবাজার থেকে আমার বড় মামা ইঞ্জিনিয়ার সামসুদ্দোহা সাহেবকে নিয়ে আমাদের ঢাকার গোপীবাগের বাসায় আসেন। বাবাকে ওই আগন্তুকেরা তাদের সঙ্গে দৈনিক পূর্বদেশ অফিসে যেতে বলে। বাবা সেই যে গেলেন, আর ফিরে আসেননি।

‘আমি আরও জেনেছি যে বাবা ফিরে না আসার কারণে বাসায় সবাই কান্নাকাটি করছিল। এই অবস্থায় আমার চাচা আ ন ম গোলাম রহমান বাবার খোঁজে দৈনিক পূর্বদেশ অফিসে যান। সেখানে গিয়ে তিনি এহতেশাম হায়দার চৌধুরী ও আতিকুর রহমানকে আমার বাবার অপহরণের কথা জানান। তখন তাঁরা আমার চাচাকে বলেন সম্ভবত চৌধুরী মঈনুদ্দীন বিষয়টি অবগত আছেন। আমি এ–ও শুনেছি তখন এহতেশাম হায়দার চৌধুরী চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ডেকে আমার চাচাকে সঙ্গে নিয়ে বাবার খোঁজ করতে বলেছিলেন কিন্তু চৌধুরী মঈনুদ্দীন চাচাকে নিয়ে কয়েকটি জায়গায় খোঁজ করে জানিয়েছিলেন যে বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমি চাচার কাছ থেকে শুনেছি মঈনুদ্দীন যখন মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে প্রবেশ করছিলেন, তখন দণ্ডায়মান প্রহরীরা তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেছিল।...আমি আরও জানতে পেরেছি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১–এর পর আমার চাচা ঢাকার আশপাশে অনেক বধ্যভূমিতে আমার বাবার লাশ খুঁজেছেন কিন্তু পাননি।’

কী অবর্ণনীয় বীভৎসতা! অসহায় স্বজনদের সামনে থেকে একজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। বধ্যভূমিতে গিয়ে তাঁর লাশ খুঁজতে হয়েছে। লাশ পাওয়া যায়নি। বর্বর ঘটনাটি শহীদের বাবাকেও ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। মাত্র ৯ মাসের সন্তান অভি বাবার স্নেহ–আদর পাননি। বাবাকে কোনো দিন বাবা বলে ডাকতে পারেননি। এই করুণ চিত্র যে কারও হৃদয়কে করবে বেদনাক্রান্ত। নাড়া দেবে বিশ্ববিবেক ও মানবতাকেও। তারপরও এই শহীদের পরিবার শত প্রতিকূলতায় সামনে এগিয়ে গেছে। এই অনির্বাণ মোস্তফা অভি যখন বাবা হারানোর কথা ব্যক্ত করতে ট্রাইব্যুনালে আসেন, তখন তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক।

আগামীকাল ছাপা হবে: নারী বুদ্ধিজীবীদেরও রেহাই দেয়নি খুনিরা
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: হাইকোর্টের বিচারপতি