Thank you for trying Sticky AMP!!

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড: বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম

তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় আছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার। এ বছরের মার্চে তাদের ৩০ বছর পূর্ণ হয়েছে। বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারি মাসে এই শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোগে এমন একটা কাজ সুসম্পন্ন হয়েছে, যা আমাদের আশাবাদী করে তোলে, আমাদের বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতাপাশেও আবদ্ধ করে। এই পাঠাগারের উদ্যোগে বের হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ। প্রকাশক আগামী প্রকাশনী। কোষগ্রন্থটি রচনা, সংকলন, সম্পাদনা করেছেন আলী মো. আবু নাঈম ও ফাহিমা কানিজ লাভা।

এমনিতেই এই পাঠাগার একটা প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান। এখানে নিয়মিত আসে শিশু-কিশোর, আর বড়রা তাঁদের বই থেকে পাঠ করে শোনান। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় কাজী আলীম-উজ-জামানের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল:

‘সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের “শ্বেতপাথরের টেবিল” গল্পটি পড়ে শোনাচ্ছেন একজন। কখনো তাঁকে দাপুটে বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে হচ্ছে, কখনোবা মৃদু স্বভাবের জ্যাঠামশাইয়ের চরিত্রে, কখনো আড়ষ্ট হয়ে থাকা মায়ের চরিত্রে। আর চারদিকে গোল হয়ে বসা কচিকাঁচারা শুনছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। কখনো চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে, কখনো মুখাবয়বে প্রসন্ন ভাব, কখনোবা ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া।

‘একটা গল্প শেষ হলে ছেলেমেয়েরা বায়না জুড়ে দিচ্ছে—আরেকটা, আরেকটা। এভাবেই শেষ হয় একটার পর একটা গল্প।

‘পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠা ১৯৮৯ সালের ৩ মার্চ, নাখালপাড়ার ২৭২ নম্বর বাড়ির একটি কক্ষে। উদ্বোধনের সময় নাম ছিল শহীদ শহীদুল্লা কায়সার স্মৃতি পাঠাগার। পরে নাম বদলে হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার।’

এবার আসি শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ নামের বিশালাকার বইটির কথায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলায় এক দম্পতি ১ হাজার ২০০ টাকার এই বইটি আমাকে উপহার দিতে চান। তাঁরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলছিলেন, প্রথম আলোয় প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ থেকে তাঁরা অনেক সাহায্য পেয়েছেন। এমন একটা মহৎ উদ্যোগকে সমর্থন জানানোর জন্য হেঁটে আগামীর স্টলে গিয়ে বইটা কিনে নিই।

বইয়ের শুরুতে ভূমিকায় অন্যতম সম্পাদক আলী মো. আবু নাঈম (সভাপতি, শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার) জরুরি একটা কথা বলে নিয়েছেন, ‘১৪ ডিসেম্বর আমরা জাতীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি। যদিও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করেছিল, তারই অংশ হিসেবে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করা শুরু হয়। আর এ কাজে তাদের সহযোগী ছিল এদেশীয় দালাল চক্র।’

বুদ্ধিজীবীদের নিধন করার কাজটা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত চালানো হয়। বুদ্ধিজীবী বলতে লেখক, শিল্পী, শিক্ষক, বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পেশাজীবী, সমাজসেবী, সংস্কৃতিকর্মী এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে তথ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ নামে একটা বই প্রকাশ করে। সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ১ হাজার ৭০ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করে। এই বইয়ে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা আরেকটু নির্দিষ্ট করা হয়, ২০১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম-পরিচয় কোষগ্রন্থটিতে ঠাঁই পায়। অনেকের ঠিকানা-তথ্য তত দিনে দুর্লভ হয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশ করে ১০ খণ্ডের স্মৃতি: ১৯৭১। দশ খণ্ডে ২৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিচারণা করেন নিকটজনেরা। এই কাজগুলোর জন্য বাংলা একাডেমি এবং রশীদ হায়দার আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে রইবেন। তবে তালিকা যে অসম্পূর্ণ, তা সবাই জানেন এবং স্বীকার করেন।

আগামীকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আজ আমার হাতে নাখালপাড়ার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোগে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ। এই বইয়ে ৩২৯ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছে। যাঁদের মধ্যে ছবি পাওয়া গেছে ১৬২ জনের।

বইটির প্রথম ভুক্তি অনীলচন্দ্র মল্লিক। মাদারীপুরের নবগ্রামের মৃৎশিল্পের ভাস্কর, অভিনেতা, খেলোয়াড়। ১৯৭১ সালের ৩০ বৈশাখ অনীলচন্দ্র মল্লিক পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করতে যান ঢাল-তলোয়ার-সড়কি-বল্লম নিয়ে, তাঁর সঙ্গীসাথিসমেত। মিলিটারি গুলিবর্ষণ করলে আরও অনেকের সঙ্গে অনীলচন্দ্র শহীদ হন।

এই কোষের দ্বিতীয় ভুক্তি অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালের ৩১ জানুয়ারি, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের জন্তারী গ্রামে। অনুদ্বৈপায়নের পরীক্ষার ফল শুনলে সশ্রদ্ধ বিস্ময় জাগে। ম্যাট্রিক পাস করেন দুটো লেটারসহ প্রথম বিভাগে, আইএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে একাদশ স্থান দখল করেন, ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হয়ে বিএসসি (অনার্স) করেন, ১৯৬৭ সালে এমএসসিতে হন প্রথম বিভাগে দ্বিতীয়। ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তাঁর কথা ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনযাত্রার। জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর ছিলেন তিনি। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সেনারা পৃথিবীর ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারই শিকার হন অনুদ্বৈপায়ন।

তাঁর শিক্ষক ছিলেন সদ্য প্রয়াত অজয় রায়। অজয় রায় অনুদ্বৈপায়ন সম্পর্কে স্মৃতিকথা লিখেছেন, ‘...দেখা হয়েছিল দক্ষিণ বাড়ির দারোয়ান মাখনের সাথে (এখন মৃত)। ক্রন্দনরত কণ্ঠে ও অনুদ্বৈপায়ন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানাল: ‘স্যারকে এরা পিছমোড়া করে দুহাত বেঁধে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে টেনে নিয়ে যায় অ্যাসেম্বলি ভবনের দিক থেকে, তারপর দক্ষিণ বাড়ির সামনে আরও ২-১ জনের সঙ্গে গুলি করে মারে।’

এবার আমাদের একটু থামতে হবে। একটু ভাবতে হবে। অপারেশন সার্চলাইটে কেবল কামান মর্টার রাইফেল মেশিনগান চালিয়ে, ছাত্রাবাস, বস্তি জ্বালিয়ে দিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা করা হয়নি, পরিকল্পিতভাবে তালিকা করে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে গুলি করেও মারা হয়েছে!

প্রথম আলোর ৪ নভেম্বর ২০১৬ সংখ্যায় এই মেধাবী শহীদ শিক্ষককে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

এই কোষগ্রন্থের শেষ ভুক্তি ডা. হেমন্ত। নীলফামারীর সন্তান হেমন্ত এলএমএফ ডাক্তার ছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে নীলফামারীর রাজাকার বাহিনীর প্রধান অবাঙালি আবদুল্লাহ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আল্লারাখা খানের দল নীলফামারীর ব্যবসায়ী ব্রজনাথ ঘোষ, ব্রজনাথের দুই ছেলে স্বপন কুমার ঘোষ, তপন কুমার ঘোষ, হোমিও চিকিৎসক বিষ্ণু, তাঁর ভাই শম্ভু, ব্যবসায়ী সালেহউদ্দিন শাহ, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহফুজুর রহমান চৌধুরী দুলু এবং জমিদার ঘিনা সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। নীলফামারীর ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে তাঁদের আটক রাখা হয়। পরে পাশের দারায়োনি জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে তাঁদের হত্যা করা হয়।

প্রথম থেকে শেষ ভুক্তি পর্যন্ত এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার মধ্যে একটা নীলনকশা, একটা পরিকল্পনা, একটা প্যাটার্ন বুঝতে পারা যায়। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, শিক্ষক, সমাজকর্মীদের ধরা হয়েছে তালিকা করে, বাছাই করে, মারা হয়েছে টার্গেট করে। ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া এবং হত্যা করা ছিল একই পরিকল্পনার শেষ এবং বৃহত্তম অংশ।

সেই যে আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে আমরা হারালাম, সেই ক্ষতি আজও পোহাতে হচ্ছে জাতিকে। এই ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হবেও না। এই হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, যারা পরিকল্পনা করেছে, যারা কার্যকর করেছে, যারা তাদের সহযোগিতা করেছে, তাদের ক্ষমা করা তাই অসম্ভব।

মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, মানব ইতিহাসে ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। তাই আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না। সে কারণেই শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি বাংলা একাডেমির প্রকাশনাগুলোকে সহজপ্রাপ্য করা দরকার। রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১, কিংবা একাত্তরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বইগুলো অমূল্য। এগুলোকে অনলাইনে প্রকাশ করে সহজে ডাউনলোড করার ব্যবস্থা করা গেলেও বিস্মৃতিপ্রবণ জাতিকে জাগ্রত করতে এগুলো চিরকাল কাজ করে যেতে পারবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক