Thank you for trying Sticky AMP!!

বেশি দেওয়া ও কম নেওয়ার নীতি

ভারতীয় রাজনীতিক-লেখক শশী থারুরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। আমেরিকার ফ্লেচার স্কুল অব ডিপ্লোমেসি থেকে মাত্র ২২ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। কফি আনান আমেরিকাকে কড়া কফির স্বাদ দিয়েছিলেন। তাই শশী থারুর যখন জাতিসংঘের মহাসচিব প্রার্থী হলেন, তখন তারা ‘আরেকজন কফি আনান’ দেখতে চাননি। মার্কিন ভেটো না থাকলে বান কি মুনের স্থলে আমরা শশীকেই দেখতাম। শশী এই পদে হলে উপমহাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা খুশি হতাম।

কিছু বিতর্ক শশী থারুরকে ছুঁয়েছে, কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি একজন উদারনৈতিক রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘কোনো ভালো হিন্দু অন্য ধর্মের ইবাদতের পবিত্র স্থানের ধ্বংসস্তূপে মন্দির দেখতে চাইতে পারে না।’

এবারের লিটফেস্টে যোগ দিতে ঢাকা এসেছিলেন শশী থারুর। খুব অল্প সময়ের জন্য বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। প্রথম আলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সংস্থা প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-এর গ্রাহক এবং শশী থারুর সেই সিন্ডিকেটের একজন লেখক। তাঁর লেখা প্রথম আলোতে নিয়মিত ছাপা হয়। আমরা কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উচ্চতম পর্যায়ে উঠেছে। এর শুরুটা হয়েছিল কংগ্রেস আমলে। শশী থারুর মনমোহন সিংয়ের সরকারে পররাষ্ট্র ও মানবসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। আগে লোকসভার পররাষ্ট্রবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। গত লোকসভা নির্বাচনের পরে মোদি সরকার তাঁকে একই কমিটিতে সদস্যপদ দিতে চাইলে তিনি সম্মতি দেননি।

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে চেন্নাইয়ে একবিংশ শতাব্দীতে ভারত শীর্ষক এক আলোচনায় শশী থারুর সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের একটি উক্তি পুনর্ব্যক্ত করেন। ঢাকায় ড. মনমোহন ২০১১ সালে বলেছিলেন, ভারত তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের অংশীদারত্ব বাদ দিয়ে তার নিজের নিয়তি নির্দিষ্ট করতে পারবে না। শশী মনমোহনের এই উক্তি উল্লেখ করেছিলেন পাকিস্তান, মালদ্বীপ, চীনের সঙ্গে দোকলাম ও রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে।

তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ২০০৬ সালে আমেরিকা ভারতকে ‘না’ বলল। ভারতের পুনরায় প্রার্থী হতে পারবে ২০৪৬ সালে। ভারতের প্রতিবেশী নীতি কি চার দশক পরে আমেরিকার ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে? এই তথ্য শশীর তিন বছর আগের একটি লেখাতেই ছিল। শশী প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ২০৪৬ সালের বিশ্বটা কী হবে তা তো কেউ বলতে পারে না। এমনকি জাতিসংঘ বলেই কিছু তখন থাকে কি না, তাই বা কে জানে। সুতরাং ওই জল্পনা বা অন্য কোনো বিবেচনায় নয়, নিজের জন্যই ভারতের প্রতিবেশী নীতি মূল্যবান।

সম্প্রতি দিল্লি এসেছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ইন্ডিয়া টুডে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে। এতে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে একাত্তরে তাঁর ভূমিকা সমর্থন করেন। কোনো অনুশোচনা নেই। একাত্তরেও তিনি ‘রিয়েল পলিটিকের’ জায়গা দেখেছিলেন, আজও তাই দেখছেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা তাঁর কাছে ধর্তব্য নয়। শশীকে বললাম, কিসিঞ্জার তাঁর সেই ‘টিল্ট’ (পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে থাকা নীতি) নীতিই অটুট রাখলেন। তবে একাত্তরে তিনি যে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘ডাইনি’ বলেছিলেন, তাঁর সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে যেতে হয়েছে। তিনি সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন। কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আমি অনুভব করি, ওঁর কাছে আমি ঋণী।’

শশীর কাছে যে কারণে প্রসঙ্গটি তোলা, সেটি হলো কিসিঞ্জারের একটি উক্তি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ভারতের সঙ্গে যদি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের সংঘাত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে থাকতে পারে। শশী থারুরের কাছে জানতে চাই, তাঁর কথায় যে ইঙ্গিত পাই, তাতে কি আপনি ট্রাম্পের দক্ষিণ এশীয় নীতির প্রতিফলন দেখেন? এর উত্তরে শশী বলেন, দেখুন, আমি কিসিঞ্জারের ভক্ত নই। নিউইয়র্কে ওঁর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। তখন বিষয়টি (’ ৭১ প্রসঙ্গ) নিয়ে তিনি আমাকে একেবারেই ভিন্ন ধারণা দিয়েছিলেন। ধারণটা হলো, ওটা ছিল ওই সময়ের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা। এখন ভারত-পাকিস্তান সংঘাত হলে তা একাত্তরের ভূরাজনীতির বিবেচনায় হবে না, আজকের বিবেচনায় হবে। সুতরাং কিসিঞ্জার তাঁর নব্বইয়ের কোঠায় দাঁড়িয়ে যা বলেছেন, সেটা আজকের আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের পরিচালিত করবে বলে আমি মনে করি না।

হয়তো শশীই ঠিক। তবে কিসিঞ্জার নিশ্চয় কথাটা আজকের ভূরাজনীতি বিবেচনাতেই বলেছেন। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এই বাণী উচ্চারণ করে নিয়ে শশী তিনটি অবস্থান নির্দেশ করেন। তাঁর কথায়, ‘এক. এখন সংঘাত হলে তা একাত্তর থেকে ভিন্ন কারণে হবে। দুই. যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিষয় বিবেচনায় নেবে, সেসব একাত্তরের অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। তিন. একাত্তরে ভারত পরাশক্তির প্রভাবে যেমনটা ভঙ্গুর ছিল, সেভাবে এখন নেই।

শশী আরও পরিষ্কার করেন যে পরাশক্তির প্রভাব আজ আসলে খুবই কম। এ জন্য তিনি গোটা পশ্চিম এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, সিরিয়া, লিবিয়া ও সাম্প্রতিক ‘কুর্দিস্তান’ পরিস্থিতির উদাহরণ দেন। আমরা দেখলাম, মৈত্রী পরিত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্র যেই সরে দাঁড়াল, অমনি তুরস্ক কুর্দিদের ওপর বোমা মারল।

শশীর মনের গহিনে বাংলাদেশ নীতি কী। জানতে চাইলাম, কংগ্রেসও কি মনে করে যে দুই দেশের সম্পর্ক গিরিশৃঙ্গে পৌঁছেছে? তিস্তা চুক্তি সইয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ব্যর্থতাকে তিনি কীভাবে দেখেন? মনে করিয়ে দিলাম, কংগ্রেস ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে কেন লিখল, তারা ক্ষমতায় গেলে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পানি তুলবে।

শশী বললেন, মনমোহন বা মোদির আমল এ জন্য দায়ী নয়। মমতা ছিলেন কংগ্রেস সরকারের অপরিহার্য মিত্র, সেটা যখন নেই, তখন বিজেপির ‘হাত একটু খোলা’। মমতার সঙ্গে বিজেপির যুদ্ধংদেহী মনোভাব আমরা হরহামেশা দেখি। কিন্তু তাই বলে তিস্তায় হাত খুলবে এমন কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। চমৎকার সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশ কী কী করেছে, শশী শুধু তার বিবরণ দেন।

অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে তিনি এ-ও স্মরণ করিয়ে দেন যে উজানের দেশ হিসেবে চীনের সঙ্গেও তো সিন্ধু নদের মতো (ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে) কোনো চুক্তি নেই। বললেন, চীন উজানে অনেক বাঁধ তৈরি করেছে, কিন্তু পানি নিচে আসছে। এ বিষয়ে ভারত নিশ্চিত বলে তার অত চিন্তা নেই। তবে শশী বলেছেন, চীন ভবিষ্যতে কখনো ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি নিলে পরে সেটা ভারতের উদ্বেগের বিষয় হবে।

আমরা যদি বুঝে থাকি, শশী সম্ভবত সরলীকরণ করেছেন। চীনের সঙ্গে ভারতের যেহেতু চুক্তি নেই, তাই উজানের দেশ হয়েও ভাটিতে ন্যূনতম প্রবাহ বজায় রাখতে চীনের আন্তর্জাতিক দায় নেই। কিন্তু এই ব্যাখ্যাকে যথাযথ বলা যাবে না। আন্তর্জাতিক নদী আইনে নিম্ন অববাহিকার দেশের যে অধিকার স্বীকৃত, তার সঙ্গে এটা যায় না। চীন উজানে পানি আটকাতে পারে না। ভারতও উজানে তা পারে না। মরণ ফাঁদ ফারাক্কার বিরুদ্ধে ভারতেই এখন জনমত প্রবল।

শশী থারুর অসম প্রতিবেশীদের মধ্যে সুসম্পর্কে বিশ্বাসী। বললেন, ‘আমি মন্ত্রী থাকতেও বলেছিলাম, উপমহাদেশের বৃহত্তম রাষ্ট্র হিসেবে যা নেব, তার থেকে প্রতিবেশীদের আমাদের অবশ্যই বেশি দেওয়া উচিত।’ আমরা তাঁর সঙ্গে একমত যে, ‘ভারতের ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সর্বদা ভারতের তরফে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই পাওয়া উচিত।’

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com