Thank you for trying Sticky AMP!!

বেশি সংখ্যা মানে বেশি স্বাধীনতা নয়

জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো চলতি বছরে বিশ্ব মুক্ত সংবাদমাধ্যম দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বা ভাবনার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছে সংবাদমাধ্যম ও গণতন্ত্র। আরও সুনির্দিষ্ট করে তারা যে বিষয়টিতে নজর দেওয়ার কথা আলোচ্য বিষয়ে তুলে এনেছে তা হচ্ছে, ‘অপপ্রচারের যুগে সাংবাদিকতা ও নির্বাচন’। আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে এই বিষয়ে বিতর্কটি আমাদের ‘রাতের বেলার ভোটের’ আগে অনুষ্ঠিত হলে তা থেকে হয়তো আমরা উপকৃত হতে পারতাম। সংবাদমাধ্যমের নির্বাচনী পরীক্ষায় আমাদের হতাশাজনক ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের বহন করতে হতো না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কদর বাড়ত না এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা পেত না।

অবশ্য বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের বিষয়ে আইন কিংবা নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের কৌশলের সবচেয়ে লক্ষণীয় উপাদান হচ্ছে, শোনা দরকার শুনব, কিন্তু মানব না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। মন্ত্রীরা সাংবাদিক-সম্পাদকসহ নানা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিপন্থী ও নিবর্তনমূলক কিছু আইনে থাকবে না বলে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু আইন তৈরির সময়ে তাঁরা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। প্রতিবাদে সম্পাদকেরা রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু অভাবিত নির্বাচনে হাকিমও নড়েনি, পরে হুকুমও নড়েনি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে মুক্ত সাংবাদিকতার পথে একমাত্র বাধা তা নয়, বরং বিদ্যমান অনেক নিয়ন্ত্রণমূলক ও অধিকার খর্বকারী বিধিবিধানের তালিকায় সর্বসাম্প্রতিক সংযোজন। তা ছাড়া ডিজিটাল আইনটি অতীতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বহুনিন্দিত ৫৭ ধারার আরও উন্নত (নেতিবাচক অর্থে) সংস্করণ। অতিমাত্রায় দলানুগত রাজনীতির কারণে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো ৫৭ ধারা বা তার কঠোরতর সংস্করণ ডিজিটাল আইনে এ পর্যন্ত কতজন সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন, তার পরিসংখ্যান নিয়ে মাথা ঘামায় না। তবে আইনের প্রয়োগ কিন্তু থেমে নেই এবং এই আইনের সবচেয়ে আলোচিত শিকার হয়েছেন বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। নির্বাচনের সময়েও আমরা দেখেছি, ভোট ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে খুলনায় একাধিক সাংবাদিক এই আইনে নিগৃহীত হয়েছেন।

কথিত মানহানি আইনের অপব্যবহারের শিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা অনেক দিন ধরেই আইনটির ফৌজদারি দায় অবসানের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ‘মানহানি’ ও ‘অনুভূতিতে আঘাত’ করার মামলা যে সাংবাদিকদের হয়রানি করার সবচেয়ে কার্যকর ও পছন্দের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্পাদকেরা। কিন্তু সেই দাবিতে কান দেওয়ার বদলে ডিজিটাল আইনেও মানহানির বিধান যুক্ত হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মালিকানাধীন গণমাধ্যমে কাজ করার কারণেও খবর প্রচার করতে গিয়ে কথিত মানহানির অভিযোগে সাংবাদিকের ঠাঁই হয়েছে কারাগারে।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে অঘোষিত ও অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ, যা প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের চেয়েও গুরুতর রূপ ধারণ করেছে। অদৃশ্য হস্তক্ষেপে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কোনো ঘোষণা ও ব্যাখ্যা ছাড়াই সংবাদভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেয়। কোনো আইন ও লিখিত রেকর্ড ছাড়াই বেসরকারি খাতের বিজ্ঞাপনে এ রকম অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য একাধিক পত্রিকাকে খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দুটি পত্রিকার সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ও তাঁর কোনো অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সম্প্রতি ছাত্র আন্দোলনের সময় সরাসরি সম্প্রচার ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করার নতুন নজির তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ২৯ বছর পর গত ৭ এপ্রিল প্রথমবারের মতো বাতিল করা হয়েছে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি (ডিক্লারেশন)। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বের রোষানলে পড়ায় নারায়ণগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় আঞ্চলিক দৈনিক যুগের চিন্তা বাতিলের বিষয়টি অবশ্য মূলধারার সংবাদমাধ্যমে খবর হিসেবেও ছাপা হয়নি।

তবে সরকার বলছে, দেশের সংবাদমাধ্যম অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বাধিক স্বাধীনতা ভোগ করছে। এই স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে তারা দেশে কতশত খবরের কাগজ বের হয় আর কত ডজন টিভি চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেসবের পরিসংখ্যান তুলে ধরে।

দুই বছর আগে এই দিনেই এই কলামেই আমি বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টির একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছিলাম, যেখানে তারা বলেছিল, ‘সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে গণমাধ্যমের (সংখ্যাগত) আধিক্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক সমর্থকদের মালিকানাধীন অথবা নিয়ন্ত্রণে। গণমাধ্যমে বহুত্ব (প্লুরালিটি) আছে, কিন্তু সেগুলোর সুর একটাই। ভিন্নমতের কোনো স্থান নেই।’ অথচ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মানে শুধু সংখ্যাধিক্য নয়, বরং সমালোচনা ও ভিন্নমত প্রকাশে সমান সুযোগের নিশ্চয়তা।

বলে রাখা ভালো, বিশ্বজুড়েই যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে এই একই ধারা অনুসৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কৌশলটি হচ্ছে, উপচে পড়া তথ্যপ্রবাহে পাঠক-দর্শকদের নাকাল করে তোলা, যাতে গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিব্রতকর ঘটনা বা খবরগুলো হারিয়ে যায়। তা ছাড়া অর্থশাস্ত্রের সূত্র অনুযায়ী, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হলে শিল্পটি রুগ্ণ হতে বাধ্য এবং সেই দুর্বলতার কারণে সরকারি আনুকূল্যের প্রতি নির্ভরতা বাড়লে রাজনীতিকদের সুবিধা অনেক। সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন, রিপোর্টার্স স্য ফ্রঁতিয়ের (আরএসএফ) সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের আবারও অবনমন ঘটেছে। এবার এই অবনমন হয়েছে চার ধাপ। আরএসএফ তার মূল্যায়নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত এবং সহিংসতায় সাংবাদিকেরাই হয়েছে সবচেয়ে বড় ‘কোলেটরাল ভিকটিমস’।

এ কথা অবশ্য মানতেই হবে যে বিশ্বজুড়ে এখন নতুন বাস্তবতা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, বিশেষ করে ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও তাঁদের ভক্ত-সমর্থকদের দ্বারা। মূলধারার সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অব্যাহত সমালোচনা ও নিন্দা এবং ক্ষেত্রবিশেষে উসকানি এক নতুন উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেশে ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগেই সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষায় সোচ্চার সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ট্রাম্পকে সাংবাদিকদের জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছিল। তিনি এখন উগ্র ডানপন্থী-কর্তৃত্ববাদী-স্বৈরতন্ত্রী নেতাদের অনুপ্রেরণা।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যদের ফারাকটা সে দেশের সংবিধানের ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গ্যারান্টিদাতা ওই সাংবিধানিক বিধানের কারণে তিনি কখন মিথ্যা বা অসত্য বলছেন, তা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাংবাদিকেরা তুলে ধরতে পারেন। ওয়াশিংটন পোস্ট তাঁর মিথ্যাচার বা বিভ্রান্তিকর বক্তব্যগুলো চিহ্নিত করার জন্য আলাদা একটি বিভাগ গড়ে তুলেছে। তাদের হিসাবে, গত সপ্তাহ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর কথা বলেছেন ১০ হাজার ১১১ বার। দ্য নিউইয়র্কার পত্রিকা তাঁর মিথ্যাচারগুলো প্রকাশের বিষয়টিকে উপজীব্য করে গত বছরের অক্টোবরে প্রচ্ছদে একটি কার্টুন ছেপেছে, যার শিরোনাম ছিল ‘এক্সপোজড’ বা উলঙ্গ। প্রেসিডেন্টের বক্তৃতার উঁচু টেবিলটির পেছনে উলঙ্গ ট্রাম্পকেই এঁকেছিলেন শিল্পী ব্যারি ব্লিট। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতায় ‘রাজা, তোমার কাপড় কোথায়’ বলে ওঠা সেই শিশুর কাজটি করেছেন শিল্পী ব্যারি ব্লিট।

ব্যঙ্গচিত্র ও রঙ্গরসাত্মক রচনায় রাজনীতিকদের খোঁচানোর চল বাংলাদেশে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ভয়ের সংস্কৃতির ছায়ায় আত্মসংবরণ বা সেলফ সেন্সরশিপও এর অন্যতম কারণ। সংবিধানের ৩৯ ধারায় চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও তা কার্যকর করার আইনগত সুরক্ষা দেওয়ার মতো স্বাধীনতা বিচার বিভাগের রয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উপেক্ষণীয় নয়। তবে এত বৈরিতার মধ্যেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার নিত্যদিনের লড়াই বজায় থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক