Thank you for trying Sticky AMP!!

বৈশ্বিক বিচারে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতীকী ছবি

১৯৩০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ছিল ১০ বছরের কম। তখন জলধর সেনের মাসিক ভারতবর্ষতে এক লেখক উল্লেখ করেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এশিয়ার ১০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। আর এক মাস পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দেবে। এক শ বছরে এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিরাট আকার ধারণ করেছে। এখন সমগ্র এশিয়ায় তার অবস্থান কোথায়? সবচেয়ে গৌরবের হতো এখন যদি এই মহাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান সেরা দশের মধ্যে থাকত।

লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক টাইমস হায়ার এডুকেশন এশিয়ার ৫০০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই তালিকার সেরা ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞানচর্চা, ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি—পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ওই জরিপ করা হয়। এই পাঁচ সূচকের মধ্যে ১০০ নম্বরে গবেষণার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে ১০ দশমিক ৭ নম্বর। পাঠদানে পেয়েছে ১৬ দশমিক ৪ নম্বর। ওই জরিপে প্রথম স্থান অধিকার করেছে চীনের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ২ নম্বরে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় স্থানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর। পাঁচ শ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে জাপানের ১১০টি, চীনের ৮১টি, ভারতের ৫৬টি, তুরস্কের ৩৪টি, পাকিস্তানের ১৪টি, মালয়েশিয়ার ১৩টি, শ্রীলঙ্কার ২টি ও নেপালের ১টি। বাংলাদেশের শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার স্থান ৪০১।

পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নির্ণয়ে জরিপ এবারই প্রথম নয়। অনেক বছর ধরেই তা হচ্ছে। গত ২৫ বছরের জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান একেবারে তলানিতে।

প্রথমবার বাংলাদেশ যখন দুর্নীতিতে দুনিয়ার সব দেশের মধ্যে ১ নম্বর হলো, অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি তার প্রতিবাদ করে লিখেছিলাম। লিখেছিলাম কারণ ওই তকমা একজন নাগরিক হিসেবে ছিল বড়ই লজ্জার। তারপর বছরের পর বছর যখন দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান অধিকার করতেই থাকল এবং দেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকায় আর কিছু বলার থাকল না। পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নমূলক খবর যখন আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে বের হলো, তখনো তার প্রতিবাদ করার মতো মুখ রইল না। তবে যা আশা করেছিলাম তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকার বিষয়টি হালকাভাবে না দেখে পর্যালোচনা করবে এবং কেন এমনটি হলো, তার কারণ অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। কোনো প্রতিষ্ঠানের নানা কারণে অধঃপতন হতেই পারে, কিন্তু তা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ তো থাকবে!

পরিহাসের মতো মনে হয়, প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ২৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের গবেষণা হয়েছে। কোনো চর্বিত চর্বণ নয়, প্রায় সব গবেষণাই ছিল মৌলিক। ২৫ বছরে কলা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদে যে গবেষণা হয়েছে, গত ৩০ বছরে সংখ্যায় নয়, ওই মানের গবেষণা হয়েছে, সে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় করতে পরবে না।

প্রথম দুই–আড়াই বছরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং তাঁর টিম বাংলা বিভাগে অবিস্মরণীয় কাজ করেছে। এই বিভাগের শিক্ষক গুরু প্রসন্ন ভট্টাচার্য, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ মৌলিক কাজ করেছেন। প্রথম বিভাগীয় প্রধান সি এল রেনের (Wrenn) নেতৃত্বে ইংরেজি বিভাগেও অনেকগুলো গবেষণা হয়। উর্দু–ফার্সি বিভাগে ফিদা আলী খান, মুইদ-উল ইসলাম বোরাহ মধ্যযুগের ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেন। কলা অনুষদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল ইতিহাস ও দর্শন বিভাগ। ইতিহাস বিভাগের রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রথম বছরেই প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে মৌলিক কাজ করেন। আহসান মঞ্জিলের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের ফার্সি বই ও দলিলপত্র তিনি ব্যবহার করেন। আহমদ ফজলুর রহমান সম্রাট আকবরের ধর্মনীতি নিয়ে গবেষণাপত্র তৈরি করেন। তাঁরা উভয়েই প্রশাসনিক দায়িত্বও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। মজুমদার জগন্নাথ হলের এবং রহমান মুসলিম হলের প্রভোস্ট হিসেবে।

প্রথম পাঁচ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয় দর্শন বিভাগে। বিভাগীয় প্রধান হরিদাস ভট্টাচার্য ছিলেন সর্বভারতীয় পর্যায়ের একজন দর্শনতত্ত্ববিদ। বিভিন্ন দর্শন সম্মেলনে তিনি অমূল্য অভিসন্দর্ভ উপস্থাপন করেছেন। উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য প্লেটোর অনুবাদ করেন, বাংলাতে প্রথম অনুবাদ। সতীশ চন্দ্র রায় অল্প কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। ওই সময় তিনি তিনটি দার্শনিক গ্রন্থ রচনা করেন, তাঁর একটি ইংরেজিতে, বিষয় ‘ধর্ম ও আধুনিক ভারত’।

মমতাজউদ্দীন আহমদ, এসআর দাশগুপ্ত, বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, বিনয়েন্দ্রনাথ রায়, পিএইচ ল্যাংলি প্রথম ১০ বছরে যেসব দার্শনিক সন্দর্ভ রচনা করেন, তার সঙ্গে তুলনীয় গবেষণা পরে আর দেখা যায়নি। অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক এসজি পানানদিকার প্রথম দু–তিন বছরের মধ্যে প্রকাশ করেন ওয়েলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব দ্য বেঙ্গল ডেলটা

বিজ্ঞান অনুষদ ছিল অতি সমৃদ্ধ এবং তার গবেষণাকাজ ছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রিতে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, অনুকূলচন্দ্র সরকার, পিসি গুহ, নলিনী মোহন বসু, জ্যোতির্ময় ঘোষ, এস সি সিও, এন কে বসু রসায়ন বিভাগকে অতি উঁচুতে নিয়ে যান। প্রথম দুই বছরে তাঁরা ২৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ বসুর এবং তাঁর বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্রদের কাজের স্বীকৃতি আইনস্টাইন থেকে পাওয়া যায়।

মেধাবী শিক্ষার্থী, সুযোগ্য শিক্ষক এবং দক্ষ প্রশাসন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। প্রথম ৫০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই তিনের কারণেই মর্যাদার স্থান করে নিয়েছিল। আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৫০ শতাংশ ছাত্র পৃথিবীর যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করার যোগ্যতা রাখেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে দায়মুক্তি দেওয়া যাবে না। সরকার উপাচার্য নিয়োগ দেয় পোঁ ধরা শিক্ষকদের; স্বাধীনচেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্নদের নয়। শিক্ষক নিযুক্ত হন একাডেমিক যোগ্যতার মাপকাঠিতে নয়, দলীয় ক্যাডারদের থেকে। শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা কিছুটা যোগ্য, তাঁরা কনসালট্যান্সিতে সময় দেন, ছাত্রদের পাঠদানে নয়। মেধাবী ছাত্ররা বড় আশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের দেয় খুব অল্পই। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা, তার কৃতিত্ব তো শিক্ষার্থীদের—বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন জ্ঞানচর্চার জায়গা। সেখানে ভিন্নমতের মানুষ নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়া অন্যদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা ভাবা যায় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এখন গ্রামের একজন সাধারণ মানুষও জানেন।

জ্ঞানই শক্তি—এই আপ্তবাক্যে যে শক্তির কথা বলা হয়েছে, তা কুস্তিগিরের দৈহিক শক্তি নয়—মস্তিষ্কের শক্তি, জ্ঞান-বুদ্ধির শক্তি। যেসব দেশ আজ উন্নত, সেসব দেশ প্রথমে জ্ঞানে অগ্রগামী হয়েছে, তারপর হয়েছে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। এর উল্টোটা ঘটেছে পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশে। জ্ঞানচর্চায় অগ্রগামী না হলে উন্নয়ন স্থায়ী হবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক