Thank you for trying Sticky AMP!!

ভাবিয়া করিও কাজ

অবরুদ্ধ এক মাস কেটে যাওয়ার পরও কাশ্মীর অস্থির ও অস্বাভাবিক

একটা মাস কেটে গেল নতুন কাশ্মীরের। গত ৫ আগস্ট রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছিল তার বিশেষ মর্যাদা। সংবিধান থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল ৩৭০ ধারা। হাত কাটলে আঙুলও যেমন চলে যায়, তেমনই ৩৭০ ধারা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হলো সংবিধানের ৩৫ (ক) ধারাও, যা রাজ্য বিধানসভাকে অধিকার দিয়েছিল রাজ্যের প্রকৃত বাসিন্দা নির্ণয়ের। ওই দিন থেকে কাশ্মীরের সঙ্গে আর কোনো ফারাক রইল না বাকি ভারতের। ওই দিন সাকার হলো শাসক দলের বহু দশকের ‘এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান’ নীতি।

সেদিন কোনো কোনো রাজ্যে কিছু মানুষের মধ্যে সে কী প্রবল উচ্ছ্বাস! ঢাকঢোল, মাদল, দামামা ও আতশবাজির রোশনাইয়ে সেদিন অকাল দীপাবলি পালিত হয়েছিল!

সেই থেকে একটা মাস কেটে আরও কটা দিন গড়িয়ে গেছে। কাশ্মীর এখনো অবরুদ্ধ এবং অস্বাভাবিক।

সলতে পাকানো শুরু অনেক আগেই। কাকপক্ষীকেও টের পেতে না দিয়ে। ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতি যেদিন ঠিক করলেন, বিকল্প সরকার তাঁরাই গড়বেন, সম্ভবত তারও আগে সলতে পাকানো শুরু। কেননা, তার পরপরই বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হলো। রাজ্য চলে গেল রাষ্ট্রপতির শাসনের আওতায়। তার আগেই বদল করা হয়েছে রাজ্যপালকে। একটু একটু করে আভাস আসতে শুরু করে আগস্ট মাসের গোড়ায়। অমরনাথযাত্রীরা তখন ভিড় জমিয়েছেন জোজিলার পাদদেশ বালতাল ও পহেলগামে। তাঁদের ঘিরে স্থানীয় দরিদ্র মুসলমানরা, ঘোড়া দিয়ে, শ্রম দিয়ে হিন্দুদের পুণ্যার্জন ঘটিয়ে যাঁরা সারা বছরের রোজগারের সিংহভাগ ওই দুই মাসে ঘরে আনেন। যাত্রী ছাড়াও উপত্যকা ভিড়ে ভিড়াক্কার দেশি-বিদেশি পর্যটকে। সব মিলিয়ে লক্ষাধিক মানুষের কলতান। গত ২ আগস্ট নিদান এল অবিলম্বে সবাইকে ফিরে যেতে হবে। সে এক চরম হুটোপাটি!

অকাশ্মীরি পর্যটক ও পুণ্যার্থীদের ফিরে যাওয়ার পাশাপাশি নিঃসাড়ে উপত্যকায় নিয়ে আসা হলো ৪০ হাজার বাড়তি আধা সামরিক বাহিনী, বাঘের আগে ফেউ আসার মতো। বাতাসে কিছু গন্ধ নিশ্চয় ছড়িয়েছিল। নইলে পাড়ায় পাড়ায় বাজার করার, এটিএমে ভিড় জমানো অথবা পেট্রলপাম্পগুলোয় জ্বালানি নেওয়ার দীর্ঘ লাইন কেন দৃশ্যমান হবে? উৎকণ্ঠিত ফারুক আবদুল্লাহ পুত্র ওমরকে নিয়ে দিল্লি এলেন প্রধানমন্ত্রীর মন বুঝতে। তাঁকে বললেন, ৩৭০ ধারা নিয়ে এমন কিছু করবেন না, যাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

এর পরের ঘটনা সবার জানা।

সেই থেকে আজও কাশ্মীর অস্থির ও অস্বাভাবিক। একটা মাস কেটে গেলেও রাজ্যের প্রশাসন আস্থাশীল নয়। তাই নিষেধাজ্ঞার বিস্তর ঘেরাটোপ থেকে মানুষকে অব্যাহতি দিতে তার অনীহা তীব্র। অঘোষিত কারফিউ ২৪ ঘণ্টা। দিবারাত্র সর্বত্র ভারী বুটের শব্দ। স্কুল খুললেও পড়ুয়া নেই। অফিস খোলা, হাজিরা নেই। ফোনের ল্যান্ডলাইন আজ খোলা তো কাল বন্ধ। হাসপাতাল খোলা অথচ প্রাণহীন। ইন্টারনেট অচল। তাই অনলাইনভিত্তিক প্রধানমন্ত্রী জন–আরোগ্য স্বাস্থ্য যোজনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের হাতে-পায়ে বেড়ি এখনো শিথিল নয়। নামী-অনামী কত রাজনৈতিক নেতা যে এখনো বন্দী, তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। সরকার এখনো সংখ্যা জানায়নি। রাজনৈতিক কাজকর্ম কবে স্বাভাবিকভাবে করতে দেওয়া হবে, তার ইঙ্গিতও এখনো নেই। কোথায় যে কী ঘটছে, অজানা। বেসরকারি ভাষ্যে যা অত্যাচার, সরকারি ভাষ্যে তা ‘নিছকই গুজব ও রাষ্ট্রদ্রোহ’। সরকার সর্বশক্তিমান। তাই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের হয়েছে সদ্যোজাত রাজনৈতিক দল ‘জম্মু-কাশ্মীর পিপলস মুভমেন্ট’-এর ডাকাবুকো নেত্রী শেহলা রশিদের বিরুদ্ধে। এই সেই কাশ্মীরি তরুণী, যিনি দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন এবং ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার-উমের খালিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর অস্বাভাবিক অত্যাচারের অভিযোগ এনে শেহলা সম্প্রতি টুইট করেছিলেন। জাতীয়তাবাদীদের তা নজর এড়ায়নি।

মোটকথা, স্বাভাবিকতা বলতে সবাই যা বোঝে, তা যে কবে দৃশ্যমান হবে, কেউ জানে না।

এই এক মাসে ভারত অবশ্য তার কূটনৈতিক সাফল্য নিয়ে উল্লসিত। উল্লসিত হওয়ার প্রথম কারণ, সিদ্ধান্তটি যে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’, তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ পশ্চিমা মিত্রশক্তি বিশেষ প্রশ্ন তোলেনি। চীন অবশ্যই গাঁইগুঁই করেছে, পাকিস্তানও। কিন্তু তেমন কল্কে পায়নি। দ্বিতীয় কারণ, জাতিসংঘসহ অন্যত্র পাকিস্তান কিছুটা একঘরে। তারা এমন কিছু এই এক মাসে করে দেখাতে পারেনি, যাতে ভারতের কপালের রেখা আরও কিছুটা গাঢ় হয়। কিন্তু এটাই শেষ কথা মেনে নিলে সেটা হবে বিরাট ভুল। কেননা, পাকিস্তানের কাছে এই মুহূর্তে কাশ্মীরের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তান। যুদ্ধদীর্ণ এই দেশে ভারতকে হটিয়ে আগামী দিনে স্বার্থ প্রোথিত করা পাকিস্তানের প্রাথমিক মূল লক্ষ্য। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তান এই মুহূর্তে তার পূর্ব প্রতিবেশীর চেয়ে এগিয়ে। লক্ষ্য হাসিলের পর তারা পূর্ব প্রান্তে নজর দেবে। আপাতত এক–দুই পা পিছিয়ে অপেক্ষা। কাশ্মীরের খেলাটা মোটেই তারা এখানে শেষ করে দিচ্ছে না।

এই ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র–সম্পর্কিত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কমিটি দাবি জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবিলম্বে কাশ্মীরের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিন। জনজীবন স্বাভাবিক করুন। সদস্যদের দাবি, আর বেশি দেরি না করে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাশ্মীর নিয়ে চিন্তাজনক বিবৃতি দিক। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও বহু ব্রিটিশ সাংসদের এই মনোভাব ভারতের পক্ষে নিশ্চিতই ভালো বিজ্ঞাপন নয়। জি-৭ শীর্ষ নেতারা ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ’ সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হননি ঠিকই, কিন্তু যত দিন কাটছে, কাশ্মীরের অব্যাহত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ তাঁদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত না হলে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কাশ্মীরি জনগণের মানবাধিকার হরণ নিয়ে রিপোর্ট দিতে পারে। সেটা ভারতের পক্ষে সুখকর হতে পারে না।

সমস্যার অন্য একটা দিকও রয়েছে। এটা ঠিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির রসায়ন বেশ ভালো। কিন্তু এটাও ভোলা উচিত নয়, দুজনের শেষ বৈঠকে ট্রাম্প বলেছিলেন, মোদি তাঁর খুব ভালো বন্ধু এবং তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অবস্থা খুব শিগগির স্বাভাবিক হয়ে যাবে। মানবাধিকারের প্রশ্নে মার্কিনদের মনোভাব ও উদ্বেগ সর্বজনবিদিত। বিষয়টি এই কদিন আগে ভারতের মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র যেমন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তেমনই স্পষ্ট হয়ে গেছে তামাম মার্কিন মনও, যখন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স কাশ্মীরিদের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি সে দেশের সরকারকে জোরালোভাবে মনে করিয়ে দেন।

অবরুদ্ধ এক মাস কেটে যাওয়ার পর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল বলেছেন, কাশ্মীরের স্বাভাবিকতা ফেরার চাবিকাঠি রয়েছে পাকিস্তানের হাতে। উপত্যকার নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখতে এই যুক্তি ভারতের বর্ম হতে পারে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জয়ী পঞ্চায়েত নেতাদের কাউকে কাউকে (অধিকাংশ জম্মু এলাকার) দিল্লিতে এনে বৈঠক করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনটি রাজনৈতিক পরিবার কাশ্মীরের দুর্দশার কারণ। তাই তাদের বাদ দিয়ে রাজ্যের নতুন রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার ছিটেফোঁটা লক্ষণ নেই। পশ্চিমা মিডিয়া তার মতো করে ‘নিত্যদুর্দশার’ যেসব আখ্যান পেশ করে চলেছে, তাতে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার কারণ নেই। আরও তিন সপ্তাহ এই রকম চললে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আসন্ন বৈঠক ভারতের কূটনীতিকে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে পড়তে হবে প্রশ্নের মুখে।

মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্ন শুধু কাশ্মীরে নয়, বড় হয়ে দেখা দিয়েছে আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির ক্ষেত্রেও। সিদ্ধান্ত দুটির রূপায়ণ ভারতের দক্ষিণপন্থী শাসক দলের ‘কোর ইস্যু’ হলেও দুটিই তাদের দাঁড় করিয়েছে আন্তর্জাতিক প্রশ্নাবলি ও নানাবিধ অস্বস্তির মুখে। ৩৭০ ধারার বিলোপ ও আসামের এনআরসি—দুটোর একটিও সম্ভবত ‘ভাবিয়া করিও কাজ’-এর সেরা নমুনা নয়।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি