Thank you for trying Sticky AMP!!

ভারতের 'দক্ষিণ এশিয়া সমস্যা'

কাঠমান্ডুর নতুন পুলিশ একাডেমির নির্মাণ ব্যয়ের পুরোটাই উপহার হিসেবে দিয়েছে চীন

মালদ্বীপের রাজনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে ভারতের অস্বস্তি এবং তিন দশক পরে আবারও সেখানে প্রত্যক্ষভাবে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের যে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, তাকে ‘ভারতের মালদ্বীপ সমস্যা’ বলে চিহ্নিত না করে ‘ভারতের দক্ষিণ এশিয়া সমস্যা’ বলেই চিহ্নিত করা দরকার। মালদ্বীপের ঘটনাপ্রবাহ দেখিয়ে দিচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এখন কার্যত বন্ধুহীন। তার চারপাশের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সরকারকেই ভারত বন্ধু বলে বিবেচনা করতে পারে। কিন্তু সেই ‘বন্ধুত্বের’ ভিত্তিতেও যে সংশয়-সন্দেহ ঢুকতে শুরু করেছে, তার ইঙ্গিত হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উক্তি, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার হওয়া নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি ভারতকে আশ্বস্ত করার বার্তা।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপট হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও চীনের প্রভাববলয় বিস্তারের তীব্র প্রতিযোগিতা। গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে, বিশেষত এশিয়া ও আফ্রিকায়, চীন তার বাণিজ্যিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে, বিনিয়োগ করেছে। চীন আত্মকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে এসে কেবল যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই তার প্রভাব বাড়াচ্ছে তা নয়, বৈশ্বিক রাজনীতিতে সুস্পষ্ট ভূমিকা নিচ্ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। এই লক্ষ্যে চীন বা ভারত যে তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনে কুণ্ঠিত নয়; চীন, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সিকিমের মধ্যকার দুর্গম দোকলাম মালভূমিতে তিন মাস ধরে অচলাবস্থা তার প্রমাণ। দোকলাম সংকটের আপাতত অবসান হয়েছে বলে মনে হলেও চীনের সরকারি সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস-এর ভাষ্য অনুযায়ী এ বছর আবারও এ দুই দেশের মধ্যে দোকলামের মতো অচলাবস্থার সূচনা হতে পারে। ভারতীয় সংবাদপত্র আনন্দবাজারকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, চীন ভুটানকে ‘টোপ’ দিয়েছে ওই জায়গার বদলে অন্য দুটি এলাকা দেবে। ভুটান তাতে রাজি হতে পারে এই আশঙ্কা করছেন ভারতের নীতিনির্ধারকেরা, যার অর্থ হবে চীনের সঙ্গে ভুটানের ঘনিষ্ঠতা এবং ভারতের ওপর চীনের চাপ বৃদ্ধি।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে ইতিমধ্যে ভারতের প্রভাব হয় ক্ষীয়মাণ অথবা অনুপস্থিত। মিয়ানমার বা পাকিস্তান বিষয়ে আলোচনার দরকার হয় না। এ দুই দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের এবং গভীর। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরে (সিপ্যাক) ৯০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ তাই বিস্ময়ের বিষয় নয়। মিয়ানমারে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পায়নি; রাখাইন প্রদেশের গভীর নৌবন্দরের ৭০ শতাংশ চীনের মালিকানা তুলে দেওয়া তার উদাহরণ। মিয়ানমারে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের আলোচনায় চীনের সহযোগিতা এবং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশকে রাজি করানো প্রমাণ করে চীনের কতটা প্রভাব। ক্ষীয়মাণ প্রভাবের উদাহরণ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ।

নেপালে ক্রমবর্ধমান চীনা উপস্থিতির একটি দৃশ্যমান প্রমাণ হচ্ছে কাঠমান্ডুর নতুন পুলিশ একাডেমি, যা নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার, পুরোটাই উপহার হিসেবে দিয়েছে চীন। নেপালে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৬০ শতাংশ এখন চীনের-৭৯ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। গত নির্বাচনে নেপালে কমিউনিস্টদের বিজয়ের একটা কারণ তাদের ভারতবিরোধী অবস্থান। নেপালের সংবিধানকে কেন্দ্র করে ভারতের আরোপিত অবরোধের সময় চীন নেপালের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, সেটা আশু বিষয়; দুই দেশের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের অসমতাই যে এই পরিবর্তনের আসল কারণ, সেটা অনস্বীকার্য।

শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানে চীনের প্রভাব হ্রাস পাবে ভারতের এমন আশা পূরণ হয়েছে বলা যাবে না; শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের হাতেই গিয়ে পৌঁছেছে, অর্থনৈতিক বিবেচনায় সেটা শ্রীলঙ্কার জন্য ইতিবাচক কি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগ ও প্রভাব দুই-ই ছিল শক্তিশালী। এখনো তা তেমনি আছে এমন দাবি করা যাবে না। আফগানিস্তানে চীনের কেবল বিনিয়োগই বাড়ছে তা নয়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সমঝোতা তৈরিতে চীনের উদ্যোগ চীনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ। মালদ্বীপের সংকট সমাধানে চীন মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে, যা জাতিসংঘের প্রস্তাবের বিকল্প।

মালদ্বীপের সংকট বিষয়ে ভারতের অবস্থানকে আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান বলে মনে হতে পারে। কেননা, এই সংকটের সূত্রপাত ১ ফেব্রুয়ারি যখন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন দেশের সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া আদেশ উপেক্ষা করে জরুরি অবস্থা জারি করেন, যা এখন আরও এক মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে। আবদুল্লাহ ইয়ামিন ২০১৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যে কর্তৃত্ববাদী আচরণ করছিলেন, এখন তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। এসব ঘটনায় ভারত ক্ষুব্ধ। কিন্তু ভারতের ক্ষোভের প্রধান কারণ অন্যত্র-তা হলো ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে গত বছরগুলোতে চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি। দেশে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের আমলেই ভারতের ওপর মালদ্বীপের নির্ভরতা হ্রাসের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ২০১২ সালে যখন তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তখন আবদুল্লাহ ইয়ামিন সরকারের পক্ষে ভারতই সবচেয়ে সরব ছিল। ইয়ামিন সরকার উপর্যুপরিভাবে যখন আদালতের ওপর তার কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে, মতপ্রকাশের পথগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, তখন ভারত সরকার সেগুলোকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করেনি। এখন মালদ্বীপের সরকার যখন চীনের ওপর নির্ভর করে ভারতের প্রভাববলয়ের জন্য হুমকি হয়েছে, তখন ভারতের জন্য তা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। চীনকে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি বলে সনদপত্র দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু মালদ্বীপে গণতন্ত্র রক্ষা ভারতের উদ্দেশ্য বলে মনে করার কারণ দেখি না।

ভারতের এবং ভারতের অবস্থানের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেক বিশ্লেষক দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের এই প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের অর্থনৈতিক শক্তির দিকেই দৃষ্টি দেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে অর্থের বিবেচনায় চীনের শক্তি প্রবল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশীরা কেবল সে কারণেই চীনের মুখাপেক্ষী হচ্ছেন তা মনে করলে পুরো চিত্র পাওয়া যায় না। এ জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের আচরণ এবং ওই সব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে যে আচরণে অভ্যস্ত, তা প্রতিবেশীদের আশ্বস্ত করে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, কিন্তু কেবল ইতিহাস দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি হয় না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়; প্রতিবেশী হিসেবে এ দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতা ইতিবাচক বলেই বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের সমতা রক্ষিত হয়নি; ভারত তার কাঙ্ক্ষিত সবকিছু আদায় করে নিতে পারলেও এর বিনিময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক স্বার্থ রক্ষিত হয়নি, ক্ষমতাসীন দল তা থেকে সুবিধা লাভ করেছে।

গত বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের সময় প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি এবং দেশের অবকাঠামোগত খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে। এ নিয়ে ভারতের যে অস্বস্তি আছে, প্রধানমন্ত্রীর কথাতেই তা স্পষ্ট। বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করতে গিয়ে ভারতকে আশ্বস্ত করতে হচ্ছে কেন তা আমাদের ভেবে দেখে দরকার। ২০১৪ সালে একপক্ষীয় নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থন ও সক্রিয়তা এবং এতে করে ক্ষমতাসীন দলের ভারতনির্ভরতার বিষয় স্পষ্ট হয়। কিন্তু এতে করে ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের নাগরিকদের কী ধারণা হয়, ভারতের নীতিনির্ধারকেরা তা বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন। সে ক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের দেওয়া আশ্বাস কি যথেষ্ট? শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের মন্তব্য যে বাংলাদেশ পাকিস্তান ও চীনের হয়ে ভারতকে অস্থিশীল করতে ভারতের আসামে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে এবং ওই বক্তব্যের প্রতি দেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিজয় কুমার সিংয়ের সমর্থন বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের যে ধারণা দেয়, তা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য উদ্বেগজনক।

ভারতের এ ধরনের আচরণই যে ‘ভারতের দক্ষিণ এশিয়া সমস্যা’ সৃষ্টি করেছে, সেটা ভারতের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, ততই ভালো।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর