Thank you for trying Sticky AMP!!

ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইনের খারাপ বার্তা

ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল উত্থাপন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছবি: সংগৃহীত

৬ ডিসেম্বর ছিল ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ২৭তম বার্ষিকী। এর ঠিক দুই দিন পরই দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা দেশটির ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধনী অনুমোদন করে। যে সংশোধনীর মাধ্যমে মুসলমানদের বাদ দিয়ে অন্য প্রধান ধর্মাবলম্বী বেনাগরিকদের ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করা হবে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ৯ ডিসেম্বর প্রস্তাবটি সংশোধনীগুলো বিল আকারে দেশটির পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়। ধারণা মতোই, ৩১১ বনাম ৮০ ভোটের বিশাল ব্যবধানে লোকসভায় অনায়াসেই পাস হয়ে যায় তা। বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সেখানে। রাজ্যসভায় যদিও দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই কিন্তু সেখানেও বিরোধী কিছু দল বিলের বিরুদ্ধে ওয়াকআউট করে কার্যত বিলটি পাসে বিজেপিকে পরোক্ষে সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিজেপি নেতৃত্ব এসব হিসাব কষেই গুরুত্বপূর্ণ এই আইন পাল্টানোর কাজে হাত দিয়েছে নতুন করে।

এখন বিলটি যাবে রাজ্যসভায়। সেখানে যদিও বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই কিন্তু বিরোধী কিছু দল বিলের বিরুদ্ধে ‘ওয়াক আউট’ করে কার্যত বিলটি চূড়ান্তভাবে পাসে বিজেপিকে পরোক্ষে সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোদি-অমিত শাহ জুটি এসব হিসাব কষেই গুরুত্বপূর্ণ এই আইন পাল্টানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন এবং তাঁরা এখনও কোন বাধার মুখে পড়েনি।

যা থাকছে নতুন আইনে
এ মুহূর্তে যেসব হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকত্বহীন অবস্থায় ভারতে বসবাস করছেন, তাঁরাই মূলত সংশোধিত নতুন আইনের প্রধান সুবিধাভোগী হবেন। বিশেষত যেসব হিন্দু দাবি করছেন, তাঁরা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ‘ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার’ হয়ে দেশ ছেড়েছেন; তাঁদের ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন আইন সাহায্য করবে বলে বিজেপি প্রচার করছে। অর্থাৎ এই হিন্দুরা ভারতে আর অবৈধ অভিবাসী বিবেচিত হবেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে সেসবও তুলে নেওয়া হবে। একইভাবে ভারতে আসা শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও সুবিধা পাবেন। তবে যাঁরা ২০১৪-এর ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তাঁরাই কেবল এ রকম সুবিধা দাবি করতে পারবেন। আইনে অবশ্য ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’-এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা কীভাবে প্রমাণিত হবে, সে সম্পর্কেও আইনে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। আইনে অমুসলমানদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কিছু শর্তও শিথিল করা হয়েছে। আগে নাগরিকত্ব পেতে বসবাসের সর্বশেষ ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকার শর্ত ছিল। এখন সেটা পাঁচ বছর করা হচ্ছে।

বিজেপি সরকার ২০১৬ সালেও নাগরিকত্ব আইনের এরূপ একটা সংশোধনী এনেছিল। তখন রাজ্যসভায় অনুমোদন করাতে পারেনি তারা সেই সংশোধনী। ওই সংশোধন প্রস্তাবের সঙ্গে এবারের আইনের কিছু পার্থক্য আছে। আগের সংশোধনীতে কোনো ‘কাট-অফ-ডেট’ ছিল না। এবার স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে অমুসলমান যাঁরা ভারতে ঢুকেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যবহার হবে। আবার পূর্বতন সংশোধনীতে পুরো দেশে নতুন বিধানের কার্যকারতার কথা বলা হলেও নতুন আইনে উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু কিছু এলাকাকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন আসামের অসমিয়া প্রধান সাতটি জেলায় নতুন আইনের কার্যকারতা থাকবে না বলা হচ্ছে।

ইসরায়েলকে অনুসরণ করছে ভারত?
এই আইনের মধ্য দিয়ে বিজেপি দেখাতে চায় ভারত হিন্দুদের জন্য একটা স্থায়ী নিরাপদ আশ্রয়। যেভাবে ইসরায়েল ইহুদিদের জন্য। এই আইন ভারতের নাগরিকত্বকে স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক ভিত্তি দিচ্ছে। নাগরিকতার শর্তগুলো যেকোনো রাষ্ট্রের একটা মৌলিক দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই বছরের ১০ ডিসেম্বর, বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে ভারত খোলামেলাভাবে ঘোষণা দিয়েই তার রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য থেকে সরে গেল। কিন্তু সেটা ভারতের সংবিধানের কিছু কিছু ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মত দিচ্ছে বিজেপি বিরোধীরা।

বিজেপি এমনভাবে বিলটিকে প্রচারে এনেছে, যাতে মনে হয় এই বিলের বিরোধিতাকারীমাত্রই হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এই বিল যে ভারতের সংবিধান ও এতদিনকার রাষ্ট্রীয় চরিত্রেরও বিরুদ্ধে যাচ্ছে; সেটা তাই বিরোধী দলগুলো উচ্চকণ্ঠে তুলে ধরতে পারছে না এবং ভোটের ভয়ে তুলে ধরতে চাইছেও না। তবে কংগ্রেস লোকসভায় এই আইনে বিরোধিতা করছে। রাজ্যসভায়ও তারা এটাকে আটকাতে চাইবে।

নতুন আইনগত সংশোধনী সবচেয়ে জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে আসামে। সেখানে যেসব অমুসলমান ইতিমধ্যে এনআরসিতে নাগরিকত্ব হারিয়েছেন, তাঁরা এই আইনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। কারণ, আগে তাঁরা এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করেছিলেন ভারতীয় নাগরিক দাবি করে। এখন নতুন আইনে সুবিধা পেতে হলে আবেদন করতে হবে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। যা হবে স্পষ্টতই প্রতারণামূলক ও স্ববিরোধিতামূলক। যদিও আসামজুড়ে বিজেপি এনআরসিতে বাদ পড়া হিন্দুদেরও নাগরিকত্বের লোভে ফেলেছে নতুন আইনে।

কৌতূহলোদ্দীপক একটা দিক হলো, আলোচ্য আইন ভারত রাষ্ট্রের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এলেও দেশটির প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যম নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনকে প্রত্যাশিত গুরুত্ব দেয়নি।

উত্তর-পূর্ব ভারত যে কারণে প্রতিবাদী
নাগরিকত্বের এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতে। বিশেষ করে আসামে। সেখানে ইতোমধ্যে ‘বন্ধ’ শুরু হয়ে গেছে ১০ ডিসেম্বর ভোর থেকে। তবে আইনের আওতা থেকে আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরার কিছু এলাকাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অরুণাচল ও নাগাল্যান্ডের যেসব এলাকা ইনার লাইন প্রথায় সুরক্ষিত, সেখানেও নতুন আইন কাজ করবে না। অর্থাৎ এসব এলাকায় যাঁরা অবৈধ অমুসলমান অভিবাসী রয়েছেন, তাঁরা আইনের সুবিধা পাবেন না বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতকে এই ছাড়ের মাধ্যমে বিজেপি সরকার সেখানকার আদিবাসীদের এই মর্মে সন্তুষ্ট করতে চাইছে যে, ওই সব এলাকায় বহিরাগত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিয়ে পুনর্বাসিত করা হবে না।

বাংলাদেশের জন্যও এই আইন বিব্রতকর
ভারতের প্রস্তাবিত নতুন নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশের জন্যও অসন্তুষ্ট হওয়ার মতো। এই আইন এমন বার্তা দেয় যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা ব্যাপকহারে নিপীড়িত হচ্ছে। যদিও এই বার্তা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। এরূপ নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্তও পাওয়া যায় না। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ধারাবাহিক ভালো সম্পর্কের মাঝে এই নাগরিকত্ব আইন, তাই একটা খারাপ প্রতিদান হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারে। উপরন্তু এই আইন বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের দেশান্তরে উৎসাহিত করতে পারে। যা বহুত্ববাদী বাংলাদেশের সমাজের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক খবর নয়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য ভারতের এই আইন উসকানিমূলক ও হীনম্মন্যতা সৃজনকারী ভূমিকাও রাখতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে রাষ্ট্রগতভাবে ভারতের পশ্চাৎধাবন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও একটা খারাপ সূচনা। ভারতের এই আইন এই অঞ্চলের অন্য সব রাষ্ট্রকে নীরবে উসকানি দিয়ে যাবে সাম্প্রদায়িকতার পথে। ফলে আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিনির্ধারণে ধর্মীয় বিবেচনা বাড়তি গুরুত্ব পাবে। ফলে বঞ্চিত হবে প্রত্যেক অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। এই বঞ্চনার কোনো একক চরিত্র থাকবে না। কারণ হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিষ্টান, শিখ সবাই কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু। ফলে বৃহত্তর অর্থে ভারতের নাগরিকত্ব আইনে কেবল বিজেপিই লাভবান হচ্ছে, কোনো বিশেষ ধর্ম নয়। এমনকি এই আইন ভারতে হিন্দুত্ববাদকে জ্বালানি দিলেও বৈশ্বিক পরিসরে ভারতের বাইরের সব হিন্দুর জন্যই সামাজিক সংকট তৈরি করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটা খারাপ ডিসেম্বর
আগামী ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় লোকসভার বর্তমান অধিবেশন শেষ হবে। ফলে বিজেপি কোনভাবেই দেরি করতে চায়নি। উত্থাপনের দিনই প্রস্তাবিত আইনটি লোকসভায় পাস করিয়ে নেয়। এর মধ্যদিয়ে বিজেপি’র রাজনীতির একরূপ দম্ভেরও প্রকাশ ঘটেছে। যার প্রকাশ হিসেবে আজ ভারতজুড়ে হিন্দুত্ববাদের নতুন এক উল্লাস দেখা যাচ্ছে। এমনকি নতুন নাগরিকত্ব বিল যখন লোকসভায় পাস হচ্ছিলো তখন কর্নাটকে বড় আকারের এক নির্বাচনী জয় পেয়েছে বিজেপি। সামগ্রিকভাবে স্পষ্ট, অযোধ্যয় রাম মন্দির নির্মাণে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ধর্মবাদী নতুন নাগরিকত্ব আইন বিজেপিকে ভাবদর্শিকভাবে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে ভারতে। দেশটির জন্য এটা কতটা শুভ হচ্ছেÑ সেটা নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতের ইতিহাসে। তবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার বহুত্ববাদীদের জন্য এটা একটা খারাপ সপ্তাহ।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক